দাদুর কাঁধে চড়ে স্নাতকের দরজা পেরোচ্ছেন সুদীপ

পাঁশকুড়ার মাইশোরা গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্যামসুন্দরপুর পাটনা গ্রামের বাসিন্দা সুদীপের বাবা দিলীপ ভাগচাষি। জমিজমা না থাকারই মতো। ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চিকিৎসার কসুর করেননি সুদীপের বাবা-মা।

Advertisement

দিগন্ত মান্না

পাঁশকুড়া শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:২৮
Share:

অবিচল: মাটির ঘরের দাওয়ায় পড়াশোনায় ব্যস্ত সুদীপ। নিজস্ব চিত্র।

জন্ম থেকে দুটো পা-ই অকেজো। মুড়তে পারেন না দুটো হাতও। সব সময় সোজা থাকা হাত দুটোর ওপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। ৯৬ শতাংশ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে এ ভাবেই লড়াই করে স্নাতকের দরজা টপকাতে চলেছেন পাঁশকুড়ার সুদীপ শাসমল।

Advertisement

পাঁশকুড়ার মাইশোরা গ্রাম পঞ্চায়েতের শ্যামসুন্দরপুর পাটনা গ্রামের বাসিন্দা সুদীপের বাবা দিলীপ ভাগচাষি। জমিজমা না থাকারই মতো। ছেলেকে সারিয়ে তুলতে চিকিৎসার কসুর করেননি সুদীপের বাবা-মা। কিন্তু চিকিৎসকেরা সুদীপকে সুস্থ করে তুলতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন। অগত্যা প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করেই এক টুকরো মাটির ঘরে লড়াই শুরু করেন সুদীপ। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মায়ের কোলে চেপেই শেষ করেছেন প্রাথমিকের পাঠ। কিন্তু বাড়ি থেকে শ্যামসুন্দরপুর পাটনা হাইস্কুল প্রায় আড়াই কিলোমিটার। পড়াশোনা চালালেও এ বার ছেলে রো়জ স্কুলে যাবে কী করে! চিন্তায় পড়ে যান বাবা-মা। নাতির পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে দিতে চাননি দাদু শম্ভুচরণ শাসমল। নিজেই রোজ নাতিকে সাইকেলে চাপিয়ে পৌঁছে দিতেন স্কুলে। নাতিকে কাঁধে চাপিয়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলা বা তিনতলায় ক্লাসে পৌঁছে দিতেন। ছুটির পর ফের নাতিকে কাঁধে করে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। বছর পঁয়ষট্টির শম্ভুচরণ আজও সেই রুটিনে ছেদ পড়তে দেননি। সুদীপ এখন শ্যামসুন্দরপুর পাটনা সিদ্ধিনাথ কলেজের এডুকেশন অনার্সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। সম্প্রতি ভর্তি হয়েছেন ডিএলএড কোর্সে। দুই কলেজেই এখনও পালা করে সুদীপকে পৌঁছে দেন শম্ভুচরণ। তাঁর কথায়, ‘‘চাই আমার নাতি সমাজে পাঁচ জনের একজন হয়ে উঠুক। যতদিন বাঁচব ওর পাশে এভাবেই থাকব।"

উচ্চ মাধ্যমিকে ৫৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছেন সুদীপ। মা সহেলি শাসমল গৃহবধূ। চাষের কাজে যখন তিনি মাঠে ব্যস্ত থাকেন তখন বাড়ির সমস্ত রান্না করেন সুদীপ নিজেই। ছেলের কথা বলতে গিয়ে চোখ ভিজে যায় সহেলিদেবীর। বলেন, ‘‘ওর রান্নার স্বাদ আমার রান্নাকেও ছাপিয়ে যায়। শারীরিক কষ্ট নিয়েও পড়াশোনা করে যাচ্ছে সংসারের অভাব ঘোচাতে।’’ সুদীপের ছোট ভাই মানস দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। অভাবের সংসারে দুই ছেলের পড়ার খরচ চালিয়ে যাওয়াটাই বাবা দিলীপবাবুর কাছে চ্যালেঞ্জ।

Advertisement

সম্প্রতি শুভেন্দু অধিকারী ফ্যান ক্লাবের পক্ষ থেকে সুদীপের পড়াশোনার জন্য ১৩ হাজার টাকা অর্থ সাহায্য করা হয়েছে বলে জানালেন সুদীপের পরিবার। মাস ছয়েক হল মাসে হাজার টাকা করে অক্ষম ভাতা পাচ্ছেন সুদীপ। তবে ভাতা নয়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান পাঁশকুড়ার এই লড়াকু যুবক। স্বপ্ন দেখেন শিক্ষক হওয়ার। এলাকার বাসিন্দা তথা পাঁশকুড়া-১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি কুরবান শাহ বলেন, ‘‘ছেলেটির লড়াইকে সম্মান জানাই। ওঁদের বাড়িটি খুবই ছোট মাটির তৈরি। বিধায়ক তহবিলের টাকায় বাড়িটা পাকা করে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।’’

নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে খেদ নেই সুদীপের। আজ, সোমবার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। তবে প্রত্যন্ত গ্রামের এই লড়াকু যুবক কোনও প্রতিবন্ধী সংস্থা থেকে ডাক পাননি। তাতে হতাশ নন সুদীপ তাঁর কথায়, ‘‘প্রতিবন্ধকতা মনে থাকে, শরীরে নয়। শিক্ষক হয়ে সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে চাই। সেটাই আমার লক্ষ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন