এক ছটাকও নিজস্ব ধানজমি নেই। অভাবী সংসারে বেশির ভাগ দিন উনুনে হাঁড়িও চড়ত না। আর এখন অন্নের স্বচ্ছলতাই নয়, আর্থিকভাবেও স্বনির্ভর হয়েছেন গ্রামের মেয়েরা। এখন কাঁথির দেশপ্রাণ ব্লকের হিঞ্চি গ্রামের মহিলাদের বেশিরভাগ সময় কাটে ‘অন্নপূর্ণা’ ধানগোলা কাজ সামলাতেই। গ্রামের কাজল, ছবি, রীণার মতো অনেকেরই রোজনামচা এখন এটাই।
এই মহিলারা সকলেই দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের সদস্য। কারও স্বামী দিনমজুর, কারও স্বামী ভ্যানরিকশা চালক, আবার কারও স্বামী সামান্য দোকান-কর্মচারী। স্বামীদের একার রোজগারে সংসারে হাঁড়ি উনুনে চড়ত না বলে হেঁসেল ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু তাতেও সারা বছরের অভাব মিটত না। সংসারের অভাব আর মহাজনদের ঋণেরর জাল ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসার অসম যুদ্ধে মরিয়া এমন ১৯ জন মহিলা সাহায্য পেলেন স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। সমিতির মহিলা নেত্রী নীতিমালা পন্ডার সঙ্গে কথা বলে তাদের মনে হয়েছিল ‘ধান’-ই তাদের খাদ্য নির্ভরতা ও বিকল্প আয়ের পথ হতে পারে।
সেই শুরু। নিজেদের টাকা জমিয়ে মহিলারা ১৯৯৮ সালে যৌথভাবে শুরু করেন ধানগোলা। নাম দেন ‘অন্নপূর্ণা ধানগোলা’। সিদ্ধান্ত নেন, ধানগোলার মজুদ ধানই সকলে প্রয়োজন মতো ধার হিসেবে নেবেন। পরিবর্তে প্রত্যেকে সদস্যকে সুদ হিসেবে মণ পিছু ১০ কিলোগ্রাম বেশি ধান গোলায় জমা দিতে হবে। প্রাথমিকভাবে সদস্য ফি হিসেবে প্রত্যেক সদস্যকে ৪০ কিলোগ্রাম বা একমন করে ধানগোলায় জমা রেখে গোলায় ধান মজুদ করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও বাধা আসে। আমাদের ৯জন সদস্য সময় মতো ধান জমা দিতে পারলেও বাকি ১০জনের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। থমকে দাঁড়ায় ধানগোলা তৈরির কাজ। মুশকিল আসানে এগিয়ে আসে স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সমিতি তাদের নিজস্ব কৃষিজমি ভূমিহীন মহিলাদের চাষ দেয়। সেই জমি ধানগোলার সদস্য ফি হিসেবে জমা দেন অনেকে।
সমিতির জমি বা অন্যের জমি ভাগে চাষ করে এখন ভাগের ধান অন্নপূর্ণা ধানগোলাতেই জমা রাখেন সদস্যরা। গোষ্ঠীনেত্রী জাহ্নবী দাস বলেন, ‘‘মাত্র ৯ মণ ধান নিয়ে যে অন্নপূর্ণা ধানগোলা শুরু করেছিলাম সেই ধানগোলা আজ ১১৫ মনেরও বেশী মজুত ধানে টইটুম্বর। তার মধ্যে ৪৮ মণ ধান সদস্যরা বতর্মানে নিজেদের প্রয়োজনে ঋণ নিয়েছেন। বাকি ৬৭ মণ ধান গোলায় মজুদ রয়েছে।” সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন পন্ডা বলেন, “সদস্যদের হার না মানা অদম্য মনোবল আর অসম্ভব পরিশ্রমের ফলেই অন্নপূর্ণা ধানগোলা আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০০৭, ২০১১ ও ১২ সালে অতিবৃষ্টি ও বন্যায় কৃষিকাজ ও চাষ নষ্ট হলেও নিজেদের সংসারের প্রয়োজনে সদস্যদের আর মহাজনের কাছে ছুটতে হয়নি। বরং প্রয়োজনীয় ধান গোলা থেকেই নিয়েই পরিস্থিতি ও সংসার সামলেছেন তারা।’’
এখন আর অন্যের জমিতে মজুর খাটতে বা গৃহপরিচারিকার কাজে না গিয়ে ছোটখাটো ব্যবসাও শুরু করেছেন বলে জানান গোষ্ঠীর দুই সদস্য রেনুকা ও রীনা। আর এক সদস্য ছবি পাল হাসিমুখে বলেন, “আগে লোকের দুয়ারে জনমজুর খাটতে বা পরিচারিকার কাজ করতে যেতাম এখন পয়সা জমিয়ে একটা জেনারেটার কিনে জেনারেটার ব্যবসা করছি।’’ একইভাবে জাহ্নবী দাস কাঠের ফার্নিচার, সন্ধ্যা পাল মুদী দোকান আর কাজল শীট চা-পানের সঙ্গে মনোহারী দোকান চালাচ্ছেন। বাড়ির ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যাচ্ছে। আগে কারুর বাড়িতে টিভি না থাকলেও এখন সকলের বাড়িতেই টিভি, মোবাইল ফোন। সংসারে এখন স্বচ্ছলতার ছোঁওয়া। এলাকার মহিলা বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রকল্প শুধুমাত্র প্রকল্প নয়, আন্দোলনও বটে।