উন্নয়ন কই, প্রশ্ন তুলছেন তৃণমূলের পঞ্চায়েত নেত্রী

কয়েক বছর আগেও প্রকাশ্যে ভোট নিয়ে আলোচনার সাহস পেতেন না সন্ধ্যারানি মাহাতো। তখন ছিল মাওবাদীদের ভয়। পুলিশ ও সিআরপি-র বন্দুক-পাহারায় ভোট দিতে যেতে হত। এখন সন্ধ্যারানিদেবী বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য। তাঁর পাড়ায় তৃণমূল আর সিপিএমের দেওয়াল লিখনও হয়েছে। অথচ ভোট নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই তিরিশোর্ধ্ব সন্ধ্যারানিদেবীর। কিন্তু কেন?

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

বেলপাহাড়ি শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৪ ০১:৪১
Share:

সন্ধ্যারানি মাহাতো। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

কয়েক বছর আগেও প্রকাশ্যে ভোট নিয়ে আলোচনার সাহস পেতেন না সন্ধ্যারানি মাহাতো। তখন ছিল মাওবাদীদের ভয়। পুলিশ ও সিআরপি-র বন্দুক-পাহারায় ভোট দিতে যেতে হত। এখন সন্ধ্যারানিদেবী বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য। তাঁর পাড়ায় তৃণমূল আর সিপিএমের দেওয়াল লিখনও হয়েছে। অথচ ভোট নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই তিরিশোর্ধ্ব সন্ধ্যারানিদেবীর।

Advertisement

কিন্তু কেন?

বৈশাখের অলস দুপুরে মাটির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন সন্ধ্যারানিদেবী। পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “এলাকায় শান্তি ফেরালে আর দু’টাকা কিলো দরে চাল দিলেই কি উন্নয়নের সব কাজ হয়ে গেল?” শাসকদলের এই জনপ্রতিনিধির আরও অভিযোগ, জঙ্গলমহলে যে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে, তার বেশিরভাগটাই লোক দেখানো। প্রত্যন্ত এলাকায় কিছুই হচ্ছে না। একগুচ্ছ উদাহরণও দেন সন্ধ্যারানিদেবী। যেমন ওড়লির মতো প্রত্যন্ত গ্রামগুলি এখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। বাম আমলে শুরু হওয়া চাকাডোবা-কাঁকড়াঝোর রাস্তার কাজও গত আড়াই এগোয়নি। রাজীব গাঁধী গ্রামীণ বিদ্যুদয়ন যোজনায় এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ এসেছে বটে, তবে তাতে অনুন্নয়নের আঁধার কাটেনি বলেই মনে করেন সন্ধ্যারানিদেবী। ততক্ষণে জড়ো হয়ে গিয়েছেন ওড়লি গ্রামের বাসিন্দা সুধারানি মাহাতো, কল্পনা মাহাতো ও অর্চনা মাহাতোরা। তাঁদের দেখিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সদস্য বলেন, “পড়শিরা এসে প্রায়ই জানতে চান, কবে গ্রামে রাস্তা হবে। পাড়ায় পানীয় জলের একটিমাত্র টিউবওয়েলের জলও সব সময় পান করা যায় না। যাঁরা আমাকে জিতিয়েছেন, তাদের কী জবাব দেব বলুন তো?” কিছুটা থেমে ফের সন্ধ্যারানিদেবীর খেদোক্তি, “আমাদের গ্রাম তো আর অনাহারের আমলাশোল কিংবা প্রাক্তন মাওবাদী নেত্রী জাগরী বাস্কের গ্রাম বগডুবা নয়। সে রকম তকমা থাকলে হয়তো কিছু কাজ হত।”

Advertisement

কাজ কি কিছুই হচ্ছে না?

এ বার সন্ধ্যারানিদেবীকে থামিয়ে দিলেন কল্পনা, অর্চনা মাহাতোরা। বললেন, “পঞ্চায়েত পুকুর খুঁড়ছিল। কিছু লোক একশো দিনের প্রকল্পে ক’দিন কাজও পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটাই তো উন্নয়নের শেষ কথা নয়। রাস্তা নেই, স্বাস্থ্য পরিষেবা বলে কিছু নেই, পানীয় জলের সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই। আগের সরকারের আমলে গ্রামে একটা এমএসকে (মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র) হয়েছিল। নতুন সরকার তো কিছুই করল না!”

একটা সময় মাওবাদীদের খাসতালুক ছিল পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা বেলপাহাড়ির ওড়লি গ্রাম। স্থানীয়রা তখন অপরিচিতের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন। এখন অবশ্য অপরিচিত সংবাদিকের কাছে ক্ষোভ উগরে তাঁরা বলছেন, “মাওবাদীরা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, শাসন করেছিল। আমাদের দাবি ছিল কাছে পিঠে একটা হাসপাতাল হোক। কিন্তু হয়নি। ২৪ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি গ্রামীণ হাসপাতালে আমরা কী ভাবে যাব, কেউ কি ভেবে দেখেছে!”

সন্ধ্যারানিদেবী জানালেন, এক সময় ঝাড়খণ্ড ও পুরুলিয়ার সীমানা এলাকার গ্রামগুলিতে ভোট এলেই আতঙ্কে রাত কাটাতেন বাসিন্দারা। মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ফতোয়া দিত। জোর-জুলুমও করত। অনেকেই কাজের অছিলায় ভোটের দিনে গা-ঢাকা দিতেন। ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে পুলিনবিহারী বাস্কে জেতার পরে পরিস্থতি বদলাতে আসরে নেমেছিল সিপিএম। অভিযোগ, মাওবাদীদের মোকাবিলা করতে গিয়ে পাল্টা সন্ত্রাস করে পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলেছিল সিপিএম।

শেফালি মাহাতোর জোয়ান ছেলে উদয় যেমন ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ। প্রাক্তন মাওবাদী উদয় মূলস্রোতে ফিরে ‘স্বপ্নপুরী’ নামে আবাসিক স্কুল চালতেন। ছোটখাটো ঠিকাদারি করতেন। স্রেফ সন্দেহের বশে সিপিএমের লোকেরা উদয়কে গুম করে দেয় বলে শেফালিদেবীর অভিযোগ। চাকাডোবা হাটে বাবুই ঘাসের দড়ি বেচে সংসার চালান উদয়ের স্ত্রী আশাপূর্ণা। চার বছরের ছেলে বিমান থ্যালসেমিয়ায় আক্রান্ত। প্রতি মাসে ধার-দেনা করে নাতিকে ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান শেফালিদেবী। চোখের জল মুছে তিনি বললেন, “বিধানসভা আর পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলের লোকেরা অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। গত জানুয়ারিতে মুখ্যমন্ত্রী যে দিন আমলাশোলে এসেছিলেন, বৌমা তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তারপরও তো ছেলের খোঁজ মিলল না!”

উন্নয়নের কাজ যে বাকি রয়েছে, তা প্রকারান্তরে মেনে নিয়েছেন পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন মন্ত্রী সুকুমার হাঁসদা। তিনি বলেন, “৩৫ বছরের অনুন্নয়ন তো আর আড়াই বছরে মিটিয়ে দেওয়া যায় না। কিছু ক্ষেত্রে আর্থিক সীমাবদ্ধতাও আছে। তবে জঙ্গলমহল জুড়ে বিস্তর কাজ হচ্ছে। বেলপাহাড়িতেও অনেক কাজ হয়েছে।” ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী পুলিনবিহারী বাস্কে অবশ্য গোটা পরিস্থিতির জন্য তৃণমূলকেই কাঠগড়ায় তুলছেন। তাঁর কথায়, “মাওবাদী-তৃণমূল জোট সন্ত্রাস করে আমাদের নামে দোষ চাপিয়েছিল। ওই পর্বে বাম কর্মী-সমর্থকেরাই সব থেকে বেশি সংখ্যায় মারা গিয়েছিলেন। আর ভোট নিয়ে মানুষের যে অনীহা তৈরি হয়েছে, সে জন্য তো তৃণমূল সরকারই দায়ী।”

বছর পনেরো আগে বেলপাহাড়ির এলাকায় সিপিএমই ছিল শেষকথা। তারপর দিনবদলের স্বপ্ন নিয়ে মাওবাদীদের সমর্থন করেছিল বাসিন্দারা। কিন্তু মাওবাদী-সন্ত্রাস বেশি দিন মেনে নিতে পারেনি তারা। এরপর মাওবাদী তাড়াতে এল ‘হার্মাদ’। তারাও সন্ত্রাসের পথে হাঁটল। ক্রমে মাওবাদী ও সিপিএম সমার্থক হয়ে উঠল বাসিন্দাদের কাছে।

আর তৃণমূল? গত পঞ্চায়েত ভোটে বেলপাহাড়ি পঞ্চায়েত সমিতি ও ব্লকের সব গ্রাম ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করেছে। কিন্তু ওড়লির বাসিন্দাদের দিন বদলায়নি। স্থানীয় সাগর ভূমিজ, সুমিত্রা ভূমিজদের আক্ষেপ, “কেউ আমাদের কথা ভাবে না। আমরা যা ছিলাম, তাই থাকব।” এই ক্ষোভের আঁচ পেয়েই বোধহয় ফের রাত-বিরেতে এলাকায় অপরিচিতের আনাগোনা শুরু হয়েছে। বৃদ্ধা সাবত্রী সিংহ বললেন, “রাতে লোকে এসে বলছে, এই তো পরিবর্তন। কী পেলি তোরা!”

কারা আসছে রাতে? এ বার বৃদ্ধার ঠোঁটের কোণে অর্থপূর্ণ হাসি। বললেন, “বাঘের এখন দাঁত নাই। আমরা আর কাউকে ডরাই না। তবে ঝড় আসছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন