ডাইন অপবাদে মারধর, অপমানে আত্মঘাতী মহিলা

বিচারসভা বসিয়ে একই গ্রামের তিন মহিলাকে ডাইনি অপবাদে লাঠিপেটা করা হয়েছিল। জানগুরু বিধান দিয়েছিল, গয়ায় গিয়ে ওই তিন মহিলার ‘দোষ’ কাটাতে হবে। তার জেরেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন এক মহিলা। এক জন গ্রাম ছেড়ে পালালেন। আর যিনি একঘরে হয়ে গ্রামে থেকে গিয়েছেন, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বাড়ির পিছনের ঝোপে।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০১
Share:

মেয়েকে হারিয়ে স্তব্ধ কিরণের বাবা-মা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

বিচারসভা বসিয়ে একই গ্রামের তিন মহিলাকে ডাইনি অপবাদে লাঠিপেটা করা হয়েছিল। জানগুরু বিধান দিয়েছিল, গয়ায় গিয়ে ওই তিন মহিলার ‘দোষ’ কাটাতে হবে। তার জেরেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন এক মহিলা। এক জন গ্রাম ছেড়ে পালালেন। আর যিনি একঘরে হয়ে গ্রামে থেকে গিয়েছেন, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন বাড়ির পিছনের ঝোপে।

Advertisement

ঝাড়গ্রাম শহর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে নেদাবহড়া অঞ্চলের কুসুমডাঙা গ্রামের ঘটনায় রীতিমতো শোরগোল পরে গিয়েছে। এলাকাটি এমন কিছু প্রত্যন্ত নয়। গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। পাঁচশো মিটারের মধ্যে আঁধারিশোলে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। আর চার কিলোমিটার দূরে পুকুরিয়ায় হাইস্কুল। তা সত্ত্বেও জঙ্গলঘেরা কুসুমডাঙায় অশিক্ষা আর কুসংস্কারের আঁধার যে ঘোচেনি এই ঘটনাই তার প্রমাণ।

তিন মহিলাকে মারধরের ঘটনাটি ঘটে গত বৃহস্পতিবার। মাতব্বরেরা জানিয়ে দেন, দোষ না কাটানো পর্যন্ত ডাইন হিসেবে চিহ্নিত তিন মহিলাকে একঘরে করে রাখতে হবে। পুলিশ-প্রশাসনে জানালে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়। শনিবার সন্ধ্যায় কীটনাশক খান ওই তিন মহিলার একজন কিরণ খিলাড়ি (৪৫)। ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতালে রাতে মৃত্যু হয় তাঁর। রবিবার মৃতদেহের ময়নাতদন্ত হয়। পুলিশ অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা রুজু করে। সোমবার ঝাড়গ্রামের বিডিও অনির্বাণ বসুর কাছে লিখিতভাবে সব জানান কিরণের বৃদ্ধা মা সুরুবালা খিলাড়ি। মেয়ের পারলৌকিক কাজের জন্য অর্থসাহায্যও চান তিনি।

Advertisement

ঘটনা মানছেন তৃণমূল পরিচালিত নেদাবহড়া পঞ্চায়েতের প্রধান সোমবারি সরেন। তাঁর বক্তব্য, “বৃহস্পতিবার কুসুমডাঙায় তিন মহিলাকে মারধর করা হয়েছিল বলে শুনেছি। এক মহিলা পরে আত্মহত্যা আপনি কিছু করেননি কেন? প্রধানের দায়সারা জবাব, “আমার কাছে কেউ অভিযোগ করেনি।” সোমবার সন্ধ্যায় ঝাড়গ্রামের বিডিও অনির্বাণ বসু কুসুমডাঙায় যান। বিডিও বলেন, “গ্রামের সবাইকে ডেকে বুঝিয়েছি, ডাইনি বলে কিছু নেই।”

সোমবার দুপুরে কুসুমডাঙায় পৌঁছে দেখা গেল থমথম করছে গোটা গ্রাম। গ্রামে ২৬টি পরিবারের বাস। কেউই আদিবাসী নন। সবাই বাগাল সম্প্রদায়ের, পদবি খিলাড়ি। সামান্য জমিতে চাষবাস আর দিনমজুরি করেই দিন চলে। স্থানীয় সূত্রে খবর, সপ্তাহ খানেক আগে লাগোয়া আঁধারিশোল গ্রামে ফণি খিলাড়ির স্ত্রী অনিতা অসুস্থ হন। তাঁর খিঁচুনি হয়েছিল। স্ত্রীকে সারাতে ঝাড়গ্রামের জিতুশোল গ্রামের এক জানগুরুর শরণাপন্ন হন। অনিতার বাঁ হাতে তাবিজ পরিয়ে জানগুরু বিধান দেন কুসুমডাঙার তিন মহিলা ডাইনি। তাঁদের নামও বলে দেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার আঁধারিশোল, কুসুমডাঙা ও পাথরচাকড়ি গ্রামের শ’খানেক লোক কুসুমডাঙার বনমাঠে বিচারসভা বসান। বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় কিরণকে। কিরণের সম্পর্কিত ভ্রাতৃবধূ বেহুলা খিলাড়ি ও পড়শি বধূ সরলা খিলাড়িকেও বিচারসভায় ডাইনি সাব্যস্ত করা হয়। তিনজনকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানোও হয়।

এ দিন দুপুরে কিরণের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল বৃদ্ধ বাবা গিরিশ ও মা সুরুবালা খিলাড়ি নির্বাক চোখে বসে রয়েছেন। সুরুবালা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, “মার খেয়ে দু’দিন ঘরে পড়েছিল মেয়েটা। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। শনিবার রাতে হঠাৎ দেখি মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে মেয়ের। মেয়ে বলল, ‘মা আমি এই অপমান নিয়ে আর বাঁচতে চাই না। কীটনাশক খেয়েছি’।” কিরণদেবীর আত্মীয় শীতল খিলাড়ির কথায়, “এত লোকের মাঝে ওরা মেয়েটাকে পশুর মতো মারধর করল। সেই অপমানটা আর ও সহ্য করতে পারল না।”

পাশেই বেহুলার বাড়ি। ঘটনার পরই তিনি ঝাড়খণ্ডে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছেন। আর এক আক্রান্ত সরলাকে অবশ্য পাওয়া গেল। হাতে-পিঠে কালসিটে দাগ। সরলা বললেন, “বৃহস্পতিবার জানগুরুর নির্দেশে গ্রামের মাতব্বরেরা কিরণ, বেহুলা ও আমাকে মারধর করে। আমার স্বামী (নৃপেন) বাধা দিতে গেলে তাঁকেও মারধর করা হয়। আমি গ্রাম ছেড়ে কোথায় যাব। দিনের বেলা বাড়ির পিছন দিকে ঝোপে থাকছি।”

আঁধারিশোলে ফণি খিলাড়িকে অবশ্য বাড়িতে পাওয়া গেল না। যাঁর অসুস্থতার জন্য এত কাণ্ড, সেই অনিতা বাড়ির উঠোনে আলু কাটছিলেন। বললেন, “তিন ডাইনির মধ্যে একটা মরেছে। তাবিজ পরে আমিও ভাল আছি। আর ভয় নেই।”

বিডিও জানান, সঙ্কট কাটাতে গোটা এলাকায় কুসংস্কার বিরোধী সচেতনতা প্রচার করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement