‘গতিই জীবন’-এই থিমে সেজে উঠেছে গিধনি পূর্বাশার মণ্ডপ। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।
কোথাও লালকেল্লা। কোথাও আবার স্বর্ণ মন্দির। কোথাও বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদসঙ্কুল পৃথিবী, কোথাও সবুজ ধানের উপর রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি। অষ্ট্রিয়ার গির্জাও হাজির অরণ্য শহরে।
মণ্ডপ ও থিমের অভিনবত্বে এ বার নজর কাড়ছে জঙ্গলমহলের বেশ কয়েক’টি সর্বজনীন পুজো। বস্তুতপক্ষে, থিমকে হাতিয়ার করে সচেতনার পাঠ শেখানোর চেষ্টা দেখা যায় সর্বত্রই। এ বার জঙ্গলমহলও তার ব্যতিক্রম নয়। ২০০৯ থেকে টানা তিন বছরের মাওবাদী অশান্তি পর্বের দরুন ওই সময় কার্যত নিয়ম রক্ষার পুজো হয়েছিল। ২০১১ সাল থেকে ছন্দে ফিরেছে জঙ্গলমহলের শারদোৎসব। এ বার কম বাজেটের মধ্যে অভিনব বিষয়বস্তু নিয়ে পুজোর আয়োজন করেছে ঝাড়গ্রাম শহরের একাধিক পুজো কমিটি।
ঝাড়গ্রাম শহরের অফিসার্স ক্লাবের মাঠে রঘুনাথপুর সর্বজনীন পুজোর থিম ‘বরফ গলে, পৃথিবী জলে’। বিশ্ব উষ্ণায়নের বিপদ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্যই এই উদ্যোগ বলে জানালেন পুজো কমিটির সম্পাদক অশোক ভট্টাচার্য। ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সুখময় শতপথী রয়েছেন মণ্ডপ রূপায়ণের দায়িত্বে। প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের উপর পৃথিবী--- এটাই মণ্ডপ। সেই পৃথিবীর চারিপাশ বরফময়। প্রকৃতি ধ্বংসের জেরে উষ্ণমণ্ডলের পরিধি কী ভাবে বাড়ছে, সেটাই দেখাতে চেয়েছেন উদ্যোক্তারা। বাজেট ৫ লক্ষ টাকা।
আবার অরণ্যশহরের পূর্বাশা ক্লাবের থিম পুজোয় সবুজ ধান গাছ, পাকা ধান, তুষ, খড় কোনও কিছুই বাদ যায়নি। সাত লক্ষ টাকা বাজেটের এই পুজোর থিম এ বার ‘ধানের খেতে রৌদ্র-ছায়ায় লুকোচুরির খেলা’। উদ্যোক্তাদের দাবি, ধান চাষের গুরুত্ব বোঝাতেই এমন থিমের আয়োজন। তিন কুইন্ট্যাল ধান বীজ থেকে ফলানো সবুজ ধান গাছের মণ্ডপ নজর কাড়বে। মণ্ডপের ভিতরে চাকদহের শিল্পীরা খড়, তুষ ও পাকা ধান দিয়ে চোখ ধাঁধানো অঙ্গসজ্জা করেছেন। পুজোর অন্যতম সংগঠন অলোক মিশ্র বলেন, “কংক্রিটের আগ্রাসনে ধানজমির পরিধি ক্রমেই কমে চলেছে। ভবিষ্যতে তীব্র খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে চলেছি। তাই নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই কৃষিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।” বলাবাহুল্য এই থিমের ‘ক্যাচলাইন’-এর জন্য রবি ঠাকুরের গানের লাইনকেই বেছে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
অরণ্যশহরের বাছুরডোবা ইয়ং ইলেভেন ক্লাবের ৫৩ বছরের পুজোয় এ বার বাজেট পাঁচ লক্ষ টাকা। কিন্তু তাতেই চমক দিচ্ছেন উদ্যোক্তারা। ‘বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা’-র থিমে লালকেল্লার আদলে মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে মানানসই ডাকের সাজের প্রতিমা। পুজো কমিটির সম্পাদক ভিকি দে বলেন, “আমাদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হল লালকেল্লা। সংহতির বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি, সাবেকি প্রতিমার মাধ্যমে আমাদের ঐতিহ্যের শিকড়-সন্ধানের চেষ্টা করেছি।”
একই ভাবে শহরের তালতলা শ্মশানের কাছে অরণ্যসুন্দরী সর্বজনীনের পুজোর থিম ‘বাউল’। একতারার আদলে মণ্ডপের অঙ্গসজ্জায় ব্যবহার করা হয়েছে অজস্র ঝুড়ি। জামদা উত্তরায়ণের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষের পুজোর মণ্ডপটি হয়েছে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের আদলে। পিছিয়ে নেই সংঘমিত্র ব্যায়াম সমিতি। অষ্ট্রিয়ার একটি গির্জায় আদলে মণ্ডপটি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ঝাড়গ্রামের গ্রামাঞ্চলেও থিম পুজোয় নানা ধরনের বিষয় উঠে এসেছে। ঝাড়গ্রাম ব্লকের মানিকপাড়ায় ‘নব অভিনন্দন’-এর চতুর্থ বর্ষের থিম পুজোয় জঙ্গলমহলের করম পরব-সহ লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে তুলে ধরা হয়েছে।
তবে এ বার জামবনির ব্লক-সদর গিধনির দু’টি সর্বজনীন পুজোকে ঘিরে রীতিমতো আগ্রহে রয়েছেন ঝাড়গ্রামবাসী। গিধনি স্পোর্টিং ক্লাবের ৭০তম বর্ষে পুজোর থিম: ‘অতল জলের আহ্বান’। গিধনি পূর্বাশা-র ১৪তম বর্ষের পুজোর থিমটিও অভিনব। আদিম যুগ থেকে বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগ পর্যন্ত গতির বিবর্তন নিয়ে পুজোর থিম: ‘গতিই জীবন’।