রকমারি ছড়া। খড়্গপুরে বামেদের দেওয়াল লিখন (বাঁ দিকে)। তৃণমূলের প্রচার লিখন মেদিনীপুরে (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
‘একই বৃন্তে তিনটি ফুল, কংগ্রেস-সিপিএম-পদ্মফুল। তিনটে দলের একটা গুণ, সন্ত্রাস আর মানুষ খুন। তাই বন্ধু আর নয় ভুল, এ বার শুধুই জোড়াফুল।’
‘শত কমরেডকে মারলি তোরা, আদর্শটাকে পারবি? মারবি যত, বাড়বে মিছিল। মার কত মার মারবি।’
বাড়ির দেওয়াল থেকে ফেসবুকের ওয়াল-ভোটের বাজারে সর্বত্রই জ্বলজ্বল করছে এমনই সব লিখন।
নির্বাচনী প্রচারে উত্তর ২৪ পরগনার মস্লন্দপুরে এক দেওয়াল লিখনে ছড়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘চোর’ বলায় এক কলেজ ছাত্র-সহ দুই সিপিএম সমর্থককে গ্রেফতার করা হয়। যে লিখন ঘিরে বিতর্ক, তার প্রথম কয়েকটা লাইন ছিল এ রকম, ‘বলছে এখন জনতা, বড় চোর মমতা। পাশ করতে টেট, নবান্নে চাই ভেট।’ ওই ছড়ায় মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করা হয়েছে, এই অভিযোগে জেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়ে ছিল তৃণমূল। এই অভিযোগের জেরেই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়।
কিন্তু তাতে কী? ভোটের ছড়া যে বঙ্গ সংস্কৃতিরই অঙ্গ! তাই ভোট মরসুমে ছড়া ছুটছেই! কোথাও বাম-সমর্থকেরা ছড়া লিখছেন, ‘শহিদের পথ পাথেয় মোদের, রক্ত ঝরানো চেতনা। আমরা জেনেছি এ কঠিন পথে, আঁখি জল ফেলা চলে না।’ ‘ভাইয়ের আয়ু বাড়বে বলে ফোঁটায় ফোঁটায় বর্ষণ, বোনের জন্য থাকে কেবল ইভটিজিং আর ধর্ষণ।’ কোথাও তৃণমূল- সমর্থকেরা ছড়া লিখছেন, ‘সিপিএমের দুই ভাই, কাটা হাত আর পদ্মফুল। এ বার দিদি দিল্লি যাবে, সঙ্গে প্রতীক জোড়াফুল।’
ছড়ার লড়াইয়ে পিছিয়ে নেই কংগ্রেস-বিজেপিও। কোথাও কংগ্রেস সমর্থকেরা লিখছেন, ‘টেট-এর চাকরি বেচে কারা টাকা খায়? কার ছবি কে কিনল দু’কোটি টাকায়? আজ কার দোষে শিল্পের হাল মরোমরো? যাও সততার প্রতীককে জিজ্ঞাসা করো।’ তো কোথাও বিজেপির দেওয়াল লিখন, ‘হাতেও নয়, কাস্তেতে নয়, ভোট নয় জোড়াফুলে। মা-ভাই-বোনেরা বেঁধেছে জোট, সব ভোট পদ্মফুলে।’
এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক সৌগত পণ্ডা বলেন, “এমন ছড়ার মাধ্যমে খুব সহজেই মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছনো যায়। ছড়া লেখার জন্যও পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। এটা এ বঙ্গেই হতে পারে!” তবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি রমাপ্রসাদ গিরির অবশ্য মন্তব্য, “ভোটের সময় ছড়া কাটাকাটি হয়ই। তবে ছড়ার মাধ্যমে ব্যক্তি কুৎসা বা ব্যক্তি আক্রমণ না করাই ভাল। সব কিছুর একটা সীমা রয়েছে!”
যুগধর্ম মেনে এখন আর শুধু দেওয়াল লিখন বা ফেস্টুনে প্রচার নয়। ভোট প্রচারে মতামতের আদান প্রদানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেরই অন্যতম অস্ত্র সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট। লোকসভার ভোট ঘিরেও ফেসবুকের দেওয়াল দখলের লড়াই জমে গিয়েছে। ওয়াল-এ নানা মন্তব্য-পোস্ট ফুটে উঠছে। শুধু কী ফেসবুক, বাড়ির দেওয়ালে দেওয়ালে এখনও ছড়া লেখা হচ্ছে। কোথাও তৃণমূল-সমর্থকেরা লিখছেন, ‘বাংলার দিশা, উন্নয়নের পথ। এ বার বাংলা গড়বে, ভারতের ভবিষ্যৎ।’ ‘লুঠ-দাঙ্গার তিনটি মুখ, কারাত-রাহুল-মোদী। এ বার ভোটে কেউ পাবে না, প্রধানমন্ত্রীর গদি।’ কোথাও বাম-সমর্থকেরা লিখছেন, ‘পেটের জ্বালায় জ্বলছে বেকার, শিল্প কিছুই নাই। অনুব্রতকে আইডল করে, সব ক’টি সিট চাই। গর্জে উঠুন বাংলার মানুষ, মিথ্যাতে নয় সাড়া। ছিল আছে থাকবে পাশে, কাস্তে হাতুড়ি তারা।’ ‘সুদীপ্ত বা সৈফুদ্দিন, স্বপ্ন ছিল বদলাবে দিন/শোধ করতে রক্তঋণ, লাল ঝান্ডা কাঁধে নিন।’
ছাত্র পরিষদের জেলা সভাপতি মহম্মদ সইফুল বলেন, “ভোটের আগে দেওয়ালে দেওয়ালে এমন ছড়া লেখালিখি তো বঙ্গ সংস্কৃতিরই অঙ্গ। ছড়ায় একটু আকচাআকচি থাকবে না, তা হয় না কি!” অন্য দিকে, বিজেপির শহর সভাপতি অরূপ দাসের বক্তব্য, “ভোটের ছড়া কি আজ লেখা হচ্ছে? সেই কবে থেকে চলে আসছে। ছড়ায় একটু আকচাআকচি থাকেই। তাতে ক্ষতি কী?” নচিকেতার গানের অনুকরণে হয়েছে দেওয়াল লিখন, ‘কেউ চায় বেচতে ভোটে, রূপের বাহার, চুলের ফ্যাশান। আমি বামপন্থী থাকব, এটাই আমার অ্যাম্বিশন।’
সারদা থেকে টেট-রাজ্যের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রতিফলনও ফুটে উঠছে দেওয়াল লিখনে। কোথাও বামেদের দেওয়াল লিখনে ফুটে উঠেছে ‘যে বেকারের জ্বলছে পেট, তৃণমূল না হওয়ায় পায়নি টেট। সেই বেকার দিচ্ছে ডাক, জোট বাঁধো তৈরি হও।’ আবার কোথাও বা ‘পেটের জ্বালায় জ্বলছে বেকার, শিল্প কিছুই নাই। অনুব্রতকে আইডল করে, সবক’টি সিট চাই। গর্জে উঠুন বাংলার মানুষ, মিথ্যাতে নয় সাড়া। ছিল আছে থাকবে পাশে, কাস্তে হাতুড়ি তারা।’
শিয়রে ভোট, তাই ছড়ার জাদুতে মানুষের কাছে পৌঁছতে তৎপর কমবেশি সব দলই।