দালাল রাজে গাড়ির লাইসেন্স পেতে নাজেহাল

একটি ছোট্ট অফিস ঘরে জনা কয়েক কর্মী। অফিসের সামনে ভিড়ের মধ্যেই চলছে দালালদের দাদাগিরি। আর তাঁদের ঘিরে অধিকাংশ মানুষেরই একটা প্রশ্ন, ‘তিন মাস পেরিয়ে গেল, আমারটা কি হয়েছে?’ উত্তর- ‘অপেক্ষা করুন। আমি আজকেই আপনার কাজটা করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’ চিত্রটা খড়্গপুর মহকুমার অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিকের কার্যালয়ের।

Advertisement

দেবমাল্য বাগচি

খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৪ ০২:০৯
Share:

খড়্গপুরের আরটিও অফিসে নতুন লাইসেন্সের জন্য গেলেই পড়তে হয় দালালদের খপ্পরে। রামপ্রসাদ সাউ।

একটি ছোট্ট অফিস ঘরে জনা কয়েক কর্মী। অফিসের সামনে ভিড়ের মধ্যেই চলছে দালালদের দাদাগিরি। আর তাঁদের ঘিরে অধিকাংশ মানুষেরই একটা প্রশ্ন, ‘তিন মাস পেরিয়ে গেল, আমারটা কি হয়েছে?’ উত্তর- ‘অপেক্ষা করুন। আমি আজকেই আপনার কাজটা করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’

Advertisement

চিত্রটা খড়্গপুর মহকুমার অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিকের কার্যালয়ের। গাড়ি চালকদের দাবি, খড়্গপুর মহকুমার দশটি ব্লকের বাসিন্দারা মোটরগাড়ির লাইসেন্সের জন্য মেদিনীপুরে পরিবহণ দফতরের জেলা অফিসে গেলে তাদের খড়্গপুরে দফতরের কার্যালয়ে পাঠানো হচ্ছে। অথচ নতুন লাইসেন্স করতে খড়্গপুরে গিয়েও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ফলে আইন ভেঙে বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালানোর প্রবণতাও বাড়ছে। আর বৈধ লাইসেন্সের প্রত্যাশায় পরিবহণ দফতরের অফিসে আসা লোকেদের লাইসেন্স করে দেওয়ার টোপ দিচ্ছেন দালালেরা। ফলে দালাল রাজের পাল্লায় পড়ে হয়রানি আরও বাড়ছে।

প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে মেদিনীপুর শহরে পরিহণ দফতরের জেলা অফিসের চাপ কমাতে খড়্গপুর মহকুমায় এই অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিকের দফতর খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই বছরের ১২ সেপ্টেম্বর রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেন এই কার্যালয়ের উদ্বোধন করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন জেলাশাসক নারায়ণস্বরূপ নিগম। খড়্গপুর ট্রাফিকে মহকুমাশাসকের কার্যালয়ের একটি ঘরে এই কার্যালয়টি চালু হয়। এখনও একইভাবে মহকুমাশাসকের তত্ত্বাবধানেই এই মোটরযান দফতরের মহকুমা কার্যালয়টি চলছে। একদিকে অফিসের ছোট জায়গায় কাজের সমস্যা, অন্য দিকে কর্মী সঙ্কটের কারণে জমছে লাইসেন্সের আবেদনের পাহাড়। তার জেরে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষেরা। জেলার আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক অভিজিৎ হাইত বলেন, “আমি জেলায় আসার পর থেকে এই অবস্থা দেখছি। ওই অফিস থেকেই খড়্গপুর মহকুমার গাড়ি চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে কর্মীর অভাবেই এই সমস্যা বলে শুনেছি। রাজ্য থেকে কর্মী পাঠালে নিশ্চয়ই সমস্যা মিটবে।”

Advertisement

পরিবহণ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, মোটর গাড়ির দফতরের ওই কার্যালয়ে এক জন অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক, এক জন মোটর ভেহিকেল টেকনিশিয়ান, দু’জন অ্যাসিস্ট্যান্ট টেকনিশিয়ান ও একজন কোষাধ্যক্ষের পদ রয়েছে। যদিও এর মধ্যে মোটর ভেহিকেল টেকনিশিয়ান সপ্তাহে শুধু বৃহস্পতিবার আসেন। আবার ২ জন অ্যাসিস্ট্যান্ট টেকনিশিয়ানের পদে রয়েছেন ২ জন ঠিকাকর্মী ও নির্বাচন দফতরের একজন কোষাধ্যক্ষকেই এই দফতরের কাজ সামলাতে হচ্ছে। খড়্গপুরের কার্যালয়ে প্রতি সপ্তাহে গাড়ির নতুন লাইসেন্সের জন্য প্রায় একশোটি আবেদন জমা পড়ে। চালকের গাড়ি চালানোর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য অফিসের কর্মীদের কার্যালয় থেকে কিছুটা দূরে ট্রাফিক এলাকার রেল ময়দানে যেতে হয়। ফলে কর্মীদের একাধিকবার অফিসের বাইরে যেতে হওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ছে।

লোকসভা নির্বাচনের সময়ে নতুন লাইসেন্স দেওয়ার জন্য মোটর সাইকেল, চার চাকা গাড়ি, অটো চালকদের গাড়ি চালানোর পরীক্ষা নেওয়ার কাজ বন্ধ ছিল। ফলে লাইসেন্সের আবেদনের সংখ্যাও দিনে দিনে বেড়েছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দালালদের রমরমা বাড়ছে। মোটা টাকার বিনিময়ে দ্রুত লাইসেন্স করে দেওয়ার টোপ দিচ্ছেন দালালেরা। তাদের খপ্পরে পড়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে। অথচ প্রশাসন নির্বিকার।

লাইসেন্স পেতে দেরি হওয়ায় বাড়ছে আইন ভাঙার প্রবণতাও। লাইসেন্সের জন্য প্রায় একশো কিলোমিটার দূর মোহনপুর ব্লকের মহিষামুণ্ড থেকে খড়্গপুরে এসেছেন ব্যবসায়ী সনাতন দাস। তিনি বলেন, “মোটর সাইকেলের লাইসেন্সের জন্য তিন মাস ধরে কতবার যে এসেছি, বলতে পারব না। এখনও ট্রায়াল হয়নি। লাইসেন্স তো পরের কথা, এত দূর থেকে বারবার মোটর সাইকেল নিয়ে আসা সম্ভব?” একই ভাবে, কেশিয়াড়ি থেকে আসা সৌম্যজিৎ দাস বলেন, “গত এপ্রিল থেকে এই নিয়ে তিন বার এলাম। লাইসেন্স করে দেওয়ার জন্য দালাল ধরেছি, তা-ও কাজ হয়নি। এত গাড়ির লাইন পেরিয়ে আমার ট্রায়াল কখন হবে, সেই আশায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।” সমস্যার কথা স্বীকার করে অতিরিক্ত আঞ্চলিক পরিবহণ আধিকারিক অমিয় কুণ্ডু বলেন, “আমি কিছুদিন আগেই এসেছি। এত আবেদনের সঙ্গে কর্মীর সংখ্যা কম হওয়াতেই সমস্যা রয়েছে। আমি উর্ধ্বতন আধিকারিকদের বিষয়টি জানিয়েছি।”

সদ্য বদলি হয়ে আসা আধিকারিক অমিয়বাবুরও ফের ঝাড়গ্রামে বদলির নির্দেশ এসেছে। বদলির নির্দেশ এসেছে সপ্তাহে এক দিন ওই কার্যালয়ে আসা মোটর ভেহিকেল টেকনিশিয়ানেরও। ফলে কর্মীর সংখ্যা আরও কমলে সমস্যা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ওই কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা মহকুমাশাসক সঞ্জয় ভট্টাচার্য বলেন, “এই কার্যালয়ের শুরু থেকেই কর্মীর একটা সমস্যা রয়েছে। সম্প্রতি আধিকারিকেরা বদলি হয়ে যাওয়ায় সমস্যা হচ্ছে। তবে আমি একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে কাজ সামলানোর চেষ্টা করছি। দালালরাজ বন্ধ করতেও পদক্ষেপ করবো। এ বিষয়ে পুলিশকেও ব্যবস্থা নিতে হবে।” তবে রাজ্য পরিবহণ দফতর থেকে স্থায়ী কর্মী-আধিকারিক না এলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব নয় তা মানছেন সকলেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন