গত বর্ষায় কোলাঘাটের বাজারে বিকোচ্ছে ইলিশ।
সীতাভোগ-মিহিদানায় বর্ধমান, ল্যাংচায় শক্তিগড়, কাঁচাগোল্লায় বনগাঁ আর রূপোলি ইলিশে? রূপনারায়ণের কোলাঘাট।
কোলাঘাট আর ইলিশ যেন একে অপরের পরিপূরক। কিন্তু, ইলিশের মরসুমেও ‘কৃপণ’ হয়ে যায় কোলাঘাটের ‘পদ্মা’! রূপনারায়ণের রুপোলি ইলিশ এখন ‘বুকিং’ ছাড়া মেলে না। কোলাঘাটের ইলিশ ব্যবসায়ী শ্রীমন্ত দাস জানালেন, শুধু তাঁর কাছেই কয়েক’শো ফোন নম্বর রয়েছে। ইলিশ উঠলে ফোন বা এসএমএসে ক্রেতাদের জানিয়ে দেন। গাড়ি হাঁকিয়ে এসে তাঁরা ইলিশ কিনে ফেরেন। দাম? ওজন অনুযায়ী, কখনও হাজার কখনও বারোশো।
মৎস্যজীবীরা রূপনারায়ণের কূলে ভিড়ছেন, এ খবর জেনে কয়েক দশক আগে বড় বড় ঝুড়ি নিয়ে ব্যবসায়ীরা আড়তের জন্য ইলিশ কিনতে যেতেন। এখন ঝুড়ি নয়, তাঁরা নিয়ে যান একটি বা দু’টি ছোট নাইলনের ব্যাগ। অধিকাংশ সময় ফেরেন খালি হাতে, কপাল ভাল হলে কখনও মিলে যায় দু’একটি। যা কার্যত নিলাম হয়।
স্মৃতি হাতড়ে কোলাঘাটের প্রবীণ মৎস্যজীবী কার্তিক পাল বললেন, “আগে ইলিশের মরসুমে জোয়ারের সময় দিনে দু’বার মাছ ধরা হত। এক একবার জাল ফেললেই এত মাছ উঠত যে কেনার লোক মিলত না! তখন বরফ দিয়ে মাছ রাখার রেওয়াজ না থাকায় বেশি মাছ উঠলে পরের দিন আর নদীতে যেতাম না।”
সুখের সে দিন আজ যেন শুধুই গল্পকথা! কোলাঘাটের স্বাদু ইলিশের লোভে ইলিশের মরশুমে আজও কলকাতা-সহ নানা এলাকা থেকে বহু ভোজন রসিক ছুটে আসেন কোলাঘাটে। কিন্তু, বিপুলা পদ্মার মতো রূপনায়ারণও আজ কৃপণ হয়ে গিয়েছে। কেমন? কোলাঘাটে এখন ইলিশের ব্যবসায়ী আছেন মাত্র দু’জন। ব্যবসাও ধুঁকছে। স্থানীয় দেনান গ্রামের পাল, বেরা পাড়ার মৎস্যজীবীদের নৌকা বাধা থাকে ঘাটে। টানাটানির সংসারেও অলস দিন কাটে তাঁদের।
রূপনারায়ণের উপরে ভাসমান ইলিশ ধরার নৌকা।
কোলাঘাটের ইলিশ নিয়ে এলাকায় বহু মজার, গর্বের ইতিহাস রয়েছে। শহরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক মহাদেব সেনগুপ্ত জানালেন, কোলাঘাট হয়ে আগে গোমো প্যাসেঞ্জার ও নাগপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন চলত। গোমো ট্রেনের বাক্স বোঝাই করে কোলাঘাটের ইলিশ যেত উত্তর ভারতে। আর নাগপুর প্যাসেঞ্জারে ইলিশ যেত মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত। মহাদেববাবু বললেন, “১৯৫৬ সালে টাটায় মাছের বাজারে গিয়ে দেখেছি মাছ বিক্রেতারা হাঁক দিচ্ছে ‘কোলাঘাটের ইলিশ’ বলে! গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল।”
এক সময় সারারাত মাছ ধরা হত রূপনারায়ণে। কাকভোরে ডাঁই করে রাখা হত সেই সব ইলিশ। সাইজ অনুযায়ী টাকায় একটা-দু’টো ইলিশ মিলত। শুধুমাত্র কোলাঘাটেই ইলিশের মাছের বড় আড়ত চলত ৫-৬টি। সেখানে ইলিশ কেনার ভিড় জমত খুচরো ব্যবসায়ীদের। সরাসরি নৌকা থেকে ইলিশ কিনতেন অনেকে। মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা জানালেন, ইলিশ মাছ বছরে দু’বার ডিম পাড়ে। জানুয়ারি এবং মে মাসে। হুগলি নদীর গেওখালি হয়ে রূপনারায়ণের মিষ্টি জলে ঢোকে ডিম ভরা ইলিশ। গেওখালি থেকে ঘাটাল পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার এলাকায় বিস্তৃত রূপনারায়ণ নদের তীরে কোলাঘাট এই রুপোলি ফসলের অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিল। কেন?
মৎস্যজীবী এবং স্থানীয়দের কথায়, এক সময় কোলঘাট সংলগ্ন রূপনারায়ণ যেমন গভীর, তেমনি চওড়া ছিল। মিষ্টি জলের এমন জায়গা ইলিশের পছন্দের। তাঁদের অভিযোগ, কিন্তু এখন রূপনারায়ণ মজে গিয়ে এবং দূষণে ইলিশের আনাগোনা অনেকটাই কমেছে। শুধু কোলাঘাটই নয়, গোটা রূপনারায়ণেই ইলিশ মেলা ভার! ইলিশের ঝাঁক আসত যে এলাকায় সেখানেই মাথা তুলেছে দুটি রেল সেতু। সাতের দশকে বিশাল সড়ক সেতু তৈরি হয়েছিল। তখনই রূপনারায়ণের স্রোত ধাক্কা খেতে শুরু করে। সেতুর দু’দিকেই চর পড়তে শুরু করে। আরও দুটি নতুন সড়ক সেতু তৈরির পরে দ্রুত মজে যাচ্ছে নদ। ভাটায় বেরিয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ চর।
মৎস্যজীবী অরুণ পাল, যুগল বেরাদের অভিযোগ, ইলিশ কমে যাওয়ার আরও একটি বড় কারণ কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দূষিত জল। আশির দশকে চালু হওয়া এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত বর্জ্য ছাই মিশ্রিত জল দেনান, বাপুর খাল হয়ে রূপনারায়ণে মেশে। দূষিত হচ্ছে জাল। কমছে ইলিশ। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি এখন আর রূপনারায়ণে দূষিত জল মেশে না। এই পরিস্থিতিতে কোলাঘাটের ইলিশের আশ মেটাতে শুরু হয়েছে ‘বুকিং’। ইলিশ ব্যবসায়ী শ্রীমন্ত দাস জানালেন, বর্ষার ভরা মরসুমে যে দিন একটু বেশি ইলিশ ওঠে সে দিন মাছ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ভাবেই কী থেকে হারিয়ে যাবে কোলাঘাটের ইলিশ?
ইলিশ সংরক্ষণের জন্য রাজ্যস্তরের একটি কমিটি রয়েছে। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট হিলসা কনজারভেশন কমিটি-র সদস্য তথা পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ দেবব্রত দাস জানান, ইলিশ কমার অন্যতম কারণ দূষণ। তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। তা ছাড়া ইলিশের মরসুমে যাতে চিংড়ি মাছের মীন ধরার কাজ যাতে না হয়, সে জন্য মৎস্যজীবীদের সচেতন করতে ওই কমিটি উদ্যোগী হয়েছে। ওই সময়ে মৎস্যজীবীদের যাতে বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করা যায়, সে জন্য অর্থ বরাদ্দ করে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
ছবি: পার্থপ্রতিম দাস