সিনেমা হলে টিকিট কাটার ‘ভিড়’ এমনই।—নিজস্ব চিত্র।
সিনেমা হলের সামনে হাউসফুল বোর্ড এখন অতীত। ডিভিডি-ইন্টারনেটের যুগে ধুঁকছে ঘাটালের সিনেমাহলগুলি!
ঘাটাল শহরে নেই কোনও মাল্টিপ্লেক্স। আধুনিক সুবিধাযুক্ত সিনেমা হল রয়েছে সাকুল্যে দু’টি। তার মধ্যে একটি হল বিক্রির অপেক্ষায়। বিপন্ন শহরের নাট্যচর্চার ঐতিহ্যও।
১৯৪০ সালে শহরে তৈরি হয় প্রথম সিনেমা হল ভারতী টকিজ। সত্তরের দশকে ‘মতি’ নামে আরও একটি সিনেমা হল হয় শহরে। তখন হল দু’টিতেই উপচে পড়ত ভিড়। প্রতিটি শো-ই চলত রমরমিয়ে। চাহিদা বেশি থাকায় চড়া দামে বিক্রি হত টিকিট। সিনেমা দেখার উন্মাদনার কাছে হার মানত টিকিটের চড়া দামও। আগে যেখানে হলগুলিতে সারা দিনের তিনটি শো মিলিয়ে গড়ে ২ হাজারের মতো দর্শক হত। এখন সংখ্যাটা তিন অঙ্কের ঘরে। সব শো মিলিয়ে গড়ে পাঁচশো দর্শকও হয় না।
একবিংশ শতকের গোড়া থেকেই হলগুলিতে দর্শকের সংখ্যা কমেছে। ভারতী টকিজের পক্ষে বঙ্কিম কুণ্ডু বলেন, “কেবল টিভিতে প্রায় প্রতিদিনই নতুন সিনেমা দেখানো হচ্ছে। সঙ্গে বিভিন্ন জনপ্রিয় মেগা ধারাবাহিকের আকর্ষণ তো আছেই। তা ছাড়াও বর্তমান গতির যুগে মানুষের ব্যস্ততা এতটাই বেড়েছে, যে তিন ঘণ্টা ধরে সিনেমা দেখার মানসিকতা ক্রমশ কমছে।” দীর্ঘ দিন ধরেই সিনেমা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বঙ্কিমবাবু আরও বলেন, “গৃহস্থ বাড়ির মহিলাদের মধ্যে সিনেমা দেখার উৎসাহ নেই বললেই চলে। এখন মুক্তির দিনই সিনেমাগুলি হলে আনা হয়, যাতে দর্শকদের সমাগম বাড়ে। কিন্তু বছর দশেক আগে থেকেই মন্দা বাড়ছে। তাই হল বিক্রির চিন্তাও রয়েছে।”
ঘাটালের একটি হলের প্রাক্তন ম্যানেজার উত্তম মালাকার বলেন, “আগে এই ব্যবসায় ভালই লাভ হত। আর এখন মন্দার বাজারে আয় ক্রমশ কমছে।” আক্ষেপ করে তিনি বলেন, “আগে দর্শকের চাপ সামলাতে গভীর রাত পর্যন্ত হলগুলিতে শো চলত। এখন আর সেই দিন নেই।”
ফিকে হয়েছে ঘাটালের নাট্যচর্চার ইতিহাসের গৌরবও। ১৯২০ সালে ঘাটালে নাট্যচর্চার সূত্রপাত। সেই সময় শহরের বৈশাখী, টাউন ক্লাব, দি ঘাটাল বিদ্যাসাগর থিয়েট্রিক্যাল ক্লাব, চাউলির মিতালি ক্লাব, সংস্কৃত পরিষদ-সহ বহু নাট্য সংস্থার নানা ঘরানার নাটক, থিয়েটার মঞ্চস্থ হত। সেই সময় শহরের নাটকের ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন বিজন ভট্টাচার্য, সাধুচরণ পাল, নন্দ দাস, উমাশঙ্কর সিংহরায়, পিনাকীরঞ্জন চক্রবর্তী, ধীরেন্দ্রনাথ দে, মদনমোহন পাল, শিবরাম হড়, রঘুনাথ হড়েদের মতো নাট্য ব্যক্তিত্বরা। তখন প্রেক্ষাগৃহে নাটকের চল তেমন ছিল না। ধৃতি-শাড়ির বড় বড় পর্দা টাঙিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হত।
সেখানে চলত নাটক। ঘাটালে শহরের বাইরে থেকেও অনেক খ্যাতনামা নাট্য ব্যক্তিত্ব পূর্ণিমা দেবী, নবদ্বীপ হালদার, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, নীতিশ মুখোপধ্যায় নাটক মঞ্চস্থ করে গিয়েছেন। পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক-সহ নানা স্বাদের নাটক দেখানো হত। মিশরকুমারী, সিরাজউদ্দৌলা, বিদ্যাসাগর, কেদার রায়, বিসর্জন-এর মতো নাটক। নাট্য ব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্যের কথায়, “নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঘাটালে নিয়মিত নাটকের চর্চা হত। ধীরে ধীরে আর্থিক সংকট, উদ্যমের অভাবের কারণে এই ঐতিহ্য ক্রমান্বয়ে লুপ্ত হতে শুরু করেছে। এখন ফি বছর বিদ্যাসাগর থিয়েট্রিক্যাল ক্লাবের পক্ষ থেকে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। নাট্য চর্চা বলতে ওইটুকুই।”
নাটকের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে দেড় বছর আগে বিভিন্ন নাট্য বাক্তিত্বদের সঙ্গে নিয়ে ঘাটাল মহকুমা নাট্য আকাডেমি তৈরি হয়েছে। আকাডেমির সম্পাদক সুব্রত দত্তের কথায়, “নাটকের ঐতিহ্যকে বাঁচাতে এখন সবাই সাহায্য করছেন। স্থানীয় যুবক-যুবতীদের সঙ্গে নিয়ে নাটকের পুরনো ঘরানাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি।” একই সঙ্গে, স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের লেখা নিয়ে ঘাটালে নিয়মিত সৃজন, সায়ন্তনী-সহ বিভিন্ন পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে।
পত্রিকাগুলিতে ঘাটালের পাপিয়া ভট্টাচার্য, রামরঞ্জন রায়, রোহিণীনাথ মঙ্গল, অজয় বাগ, তুষারকান্তি ঘোষ, অনুপম মুখোপাধ্যায়, কেশবচন্দ্র মণ্ডল-সহ বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। শহর থেকে প্রকাশিত সৃজন পত্রিকার সম্পাদক তথা প্রাক্তন শিক্ষক লক্ষ্মণ কর্মকার বলেন, “মাঝে-মধ্যেই কবি সম্মেলন, সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দিতে প্রায় সাহিত্য নিয়ে আড্ডার আসরও বসে।”