দর্শক নেই, বন্ধের অপেক্ষায় সিনেমাহল

শীতের দুপুরে কানায়-কানায় দর্শকে পূর্ণ সিনেমা হল। ‘শাহেনশা’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের ডায়ালগ শোনার জন্য হলের বাইরেও মানুষের জটলা। সালটা ১৯৮৮, তারপর কেটে গিয়েছে দু’দশকেরও বেশি সময়। সে দিনের জমজমাট অজন্তা সিনেমা হল আজ জীর্ণ।

Advertisement

দেবমাল্য বাগচি

ডেবরা শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:১০
Share:

বালিচকের রূপছায়া সিনেমা হলে ফাঁকা দর্শক আসন। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

শীতের দুপুরে কানায়-কানায় দর্শকে পূর্ণ সিনেমা হল। ‘শাহেনশা’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের ডায়ালগ শোনার জন্য হলের বাইরেও মানুষের জটলা। সালটা ১৯৮৮, তারপর কেটে গিয়েছে দু’দশকেরও বেশি সময়। সে দিনের জমজমাট অজন্তা সিনেমা হল আজ জীর্ণ। ডেবরার বাসিন্দা বাবলু মহেশের আক্ষেপ, “আমরা তখন তরুণ, এই হলে ‘শাহেনশা’, ‘ছোটবউ’, ‘আনারি’, ‘ডর’-এর মতো কত সিনেমা দেখেছি। টেলিভিশনের রমরমা যেন সবকিছু ওলট-পালট করে দিল। বন্ধ হলের সামনে দাঁড়িয়ে সে সব কথা আজও মনে পড়ে।”

Advertisement

শুধু অজন্তা নয়, জাতীয় জাতীয় সড়কের ধারে বন্ধ পড়ে রয়েছে ‘মণিহার’ সিনেমা হলও। বন্ধ হয়ে গিয়েছে ডেবরা-বালিচকের ছ’টি ভিডিও হলও। হলগুলিতে বর্তমানে ভাড়া দেওয়া হয়েছে অফিসঘর গুদাম, দোকানপাট। অজন্তা সিনেমাহলের মালিক অমলকৃষ্ণ দে বলেন, “আমাদের সিনেমা হল এক সময় এত জনপ্রিয় ছিল, যে আসন দেওয়া মুশকিল ছিল। প্রথমে ভিডিও হল ও পরে টেলিভিশনের দাপটে হল বন্ধ হয়ে যায়।” স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, আগে সাধারণ মানুষের মধ্যে সিনেমা দেখার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। ফলে হলগুলোতে দর্শকদের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত জায়গা দেওয়া যেত না। ফলে অনেকেই ভাল ব্যবসার আশায় ভিডিও হল গড়ে তোলেন। গড়ে ওঠে বালিচকের নটরাজ, ন্যাশনাল, তিরুপতি, ডেবরার প্রিয়দর্শিনী, সত্যনারায়ণে মতো ভিডিও হল। সত্যনারায়ণ ভিডিও হলের মালিক বলেন, “সিনেমা হলে দর্শকদের চাপ দেখে লাভের আশায় ভিডিও হল খুলেছিলাম। সিনেমাহল গুলিতে তখনও রিল ব্যবহার করে সিনেমা দেখানো হত। আর ভিডিও হলে চলত স্যাটেলাইটে সিনেমা। কিন্তু কেবল-টিভির দাপটে সব যেন কেমন হারিয়ে গেল।”

তবে বর্তমান যুগে যেখানে নবীন প্রজন্ম মাল্টিপ্লেক্সমুখী, সেখানে ডেবরা-বালিচকের কোনও সিনেমা হলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও নেই। ১৯৫৬ সাল থেকে চলছে বালিচকের একমাত্র সিনেমা হল রূপছায়া। ভাঙা চেয়ার, বিকল ফ্যান, কালো পর্দা নিয়ে হলের জীর্ণ দশা। ডেবরার কলেজ পড়ুয়া মণীষা মাজী, কৃষ্ণেন্দু ধারার কথায়, “গরমে সিনেমা হলে গেলে অস্বস্তি বাড়ে। কোনও নিরাপত্তা নেই, হলের মধ্যেই ধুমপান চলে। বাতানুকুল না হোক, অন্তত হলের মান্ধাতার আমলের পরিকাঠামো বদল হলেও হল ভাল চলবে।” হলের আধুনিকীকরণের প্রয়োজনীয়তার কথা মানছেন দেবেশ দাসও। তিনি বলছিলেন, “মান্ধাতার আমলের হলে এখনকার ছেলেমেয়েরা সিনেমা দেখতে পছন্দ করবে না, এটাই তো স্বাভাবিক। আগে আমরা সাদা-কালো টিভি দেখেই খুশি হতাম। আর এখন নতুন প্রজন্ম বাড়িতে সর্বক্ষণ এলইডি টিভি দেখে। তাই হলের পরিষেবা উন্নয়নের বিষয়ে চিন্তা প্রয়োজন।”

Advertisement

যদিও হল মালিকদের দাবি, ডেবরার অধিকাংশ মানুষ চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। তাই মাল্টিপ্লেক্স গড়ে উঠলে সিনেমা দেখার খরচও বাড়বে। এলাকার বাসিন্দারা সেই টাকা খরচ করতে চাইবেন না। তবে বাস্তবে ডেবরায় বাণিজ্যের পরিমাণ আগের থেকে বেড়েছে। ফলে মানুষের হাতে বেড়েছে টাকার জোগানও। যদিও সিনেমা হল মালিকদের মতে, বর্তমানে টাকা খরচ করে নতুন সিনেমা আনা হলেও ভিড় হচ্ছে কোথায়। এক একটি শোতে মেরেকেটে জনা পঞ্চাশেক দর্শকও হয় না। রূপছায়ার ম্যানেজার স্বপনকুমার সিংহ বলেন, “এই সিনেমাহল ডেবার ব্লকের প্রথম প্রেক্ষাগৃহ। আগে হলে ভিড় সামলানো যেত না। কিন্তু এখন সিনেমাহলে ব্যবসা অনেক কমে গিয়েছে। বালিচক-ডেবরায় কম বাজেটের সিনেমা এনেও টাকা তোলা যায় না। তাই ফেব্রুয়ারির পরে হল বন্ধ করে দেওয়ার ভাবনা রয়েছে।”

যদিও একসময় ডেবরার সাংস্কৃতিক চর্চা ছিল যথেষ্টই। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, বালিচকের বাসিন্দা প্রফুল্ল রায় ও বিভূতি হুই একসঙ্গে বেশ কিছু ছায়াছবির পরিচালনা করেছিলেন। তাঁরাই পরে রূপছায়া সিনেমা হল চালু করেছিলেন। শুধু সিনেমা নয়, শহরের গান-বাজনা-নাটকের ইতিহাসও ছিল গৌরবময়। বর্তমানে যেখানে বালিচক প্রাথমিক বিদ্যালয়, সেখানে প্রায় পঁয়ষট্টি বছর আগে চলত চারুকলা স্কুল। সেই স্কুলেই ছেলেমেয়েদের নাচ-গান-আবৃত্তি শেখানোর আসর বসত। তাই এখনও স্থানীয় প্রবীণ লোকেরা প্রাথমিক স্কুলটিকে চারুকলা স্কুল নামে ডাকেন। খেলাধুলো ও নাটকে জগতে ব্রিটিশ আমলের বালিচক ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন ছিল পরিচিত নাম। ডেবরার ঐতিহ্যশালী বালিচক ক্লাব রুরাল লাইব্রেরির সম্পাদক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “২০০১ সালে ক্লাবের উদ্যোগে বালিচকে এয়োদশ জেলা বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আগামীদিনেও স্থানীয়ভাবে বইমেলা চালু করার ভাবনা রয়েছে।”

তবে নব্বইয়ের দশকের পর থেকে থমকে যায় ডেবরার সাংস্কৃতিক চর্চার ঐতিহ্য। ১৯৮৯ সাল থেকে বালিচকে ‘গীতবিথিকা’ নামে গানের স্কুল চালাচ্ছেন সঙ্গীতশিল্পী আশিস ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, “ছোটবেলায় দেখেছি, এখানে কোনও প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের মতো শ্রদ্ধেয় শিল্পীরা আসতেন। বহু ছেলেমেয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় যোগ দিত। কিন্তু একসময় সব হারিয়ে যেতে বসেছিল।” তবে আশিসবাবুর বক্তব্য, “এখন দেখছি সংস্কৃতি চর্চায় ফের ছেলেমেয়েদের ঝোঁক বাড়ছে। আমরাও উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছি।”

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর মেদিনীপুর’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান: www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন