রাসমণ্ডল গ্রামের মাঠে চলছে নাটক। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র।
কিছুক্ষণ আগেই জানগুরুর নিদানে গাঁয়ের মাতব্বররা ডাইন ঠাওরে বৃদ্ধাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। রক্তাক্ত দেহ আকড়ে কাঁদছেন বৃদ্ধার মেয়ে-জামাই। মাঠভরা দর্শক বিস্ফারিত চোখে দেখছেন কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনর্নির্মাণ। আচমকা দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন! মৃত বৃদ্ধা নড়ছেন কেন?
দর্শকদের বিস্ময়ের ঘোর ভাঙিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ‘কালন্দি মুর্মু’-র চরিত্রাভিনেত্রী শ্রীপর্ণা পাহাড়ি। তারপর বৃদ্ধার ভূমিকায় স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অঙ্গনমঞ্চ থেকে আবালবৃদ্ধবনিতার মাঝে মিশে গিয়ে গাঁওলি ভাষায় প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি। “কী দোষ করেছি আমি? আমার জমিটা দখল করবে বলে আমাকে ডাইনি সাজিয়ে দেওয়া হল, আর তোমরা সবাই সে কথা বিশ্বাস করলে? তোমাদের ঘরেও তো বৃদ্ধা মা-পিসিরা রয়েছেন। ভেবে দেখ, তোমাদের ঘরেও তো কোনও দিন লোভের আগুন জ্বলতে পারে। বল, আমি কি সত্যিই ডাইনি?” জনতা নিরুত্তর। মাথা নিচু করে বসে প্রবীণরা। উৎসাহী নবীন প্রজন্মের যারা মোবাইল ফোনে শ্রীপর্ণার অভিনয়ের ছবি তুলছিলেন, তাদের কেউ কেউ জবাব দেন, “না-না তুমি ডাইনি নও।”
শুক্রবার বৃষ্টিঝরা বিকেলে লালগড় ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে রাসমণ্ডল গ্রামের লাগোয়া মাঠে ডাইনি বিরোধী নাটক দেখানো হল এলাকাবাসীদের। জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সহযোগিতায় ঝাড়গ্রামের ‘কুরকুট’ সংস্থা প্রদর্শন করল তাদের অঙ্গন নাটক ‘আঁধার মানুষ’। বৈতা গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে রাসমণ্ডল-সহ আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের নাটকটি দেখতে আসার জন্য প্রচার করা হয়েছিল। বিকেল থেকে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় চিন্তায় পড়ে যান আয়োজকরা। বিকেল পাঁচটা নাগাদ বৃষ্টি ধরতেই ভিজে মাঠে নাটক প্রদর্শনের তোড়জোড় শুরু করে দেন ‘কুরকুট’-এর সদস্যরা। বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজির হন কয়েকশো গ্রামবাসী।
নাটক শুরুর আগে প্রারম্ভিক ভাষণে লালগড়ের বিডিও জ্যোতিন্দ্রনাথ বৈরাগী ও লালগড় থানার আইসি অরুণ খান বলেন, “কুসংস্কারে প্ররোচিত হয়ে কখনই আইনকে নিজের হাতে তুলে নেবেন না। নাটকটি দেখে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করুন। পাড়া-প্রতিবেশীদের সচেতন করুন। স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু মানুষ ডাইনি অপবাদ দিয়ে এই ধরনের জঘন্য কাজ করেন। অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়েছে। আইন আইনের পথে চলবে।”
মাত্র আধ ঘণ্টার নাটকে দর্শকদের মন জয় করে নেন কুরকুট-এর কুহু দাশগুপ্ত, জিয়াউর রহমান, সমীরণ দে, তাপস নন্দীর মতো কুশীলবরা। সংস্থার সম্পাদক উপল পাহাড়ি দর্শকদের উদ্দেশে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলেন, “আমরা ঘটনাটির পুনর্নির্মাণ করেছি মাত্র। যতটা সম্ভব সত্যের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেছি ।” সবশেষে সাঁওতালি ভাষায় কুসংস্কার বিরোধী সঙ্গীত পরিবেশন করেন সাংস্কৃতিক কর্মী সুমন্ত মুর্মু। কালন্দিদেবীর মেয়ে আহ্লাদীদেবী অবশ্য নাটক দেখতে আসেন নি। তিনি পুলিশের আশ্রয়ে রয়েছেন।