শিকেয় নিষেধাজ্ঞা

পাট্টার জমিতেই গজিয়ে উঠেছে হোটেল

নিষেধাজ্ঞা না মানাটাই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আইনের তোয়াক্কা না করেই সমুদ্রের একশো মিটারের মধ্যেই গজিয়ে উঠেছে হোটেল-লজ। সৈকত পর্যটন কেন্দ্র মন্দারমণির কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সৈকতের ধারের ৮৫টি হোটেলের মধ্যে ৩১টি হোটেলই গড়ে উঠেছে পাট্টা দেওয়া জমির উপর। পাঁচটি হোটেল মালিকের কাছে নির্মাণের কোনও বৈধ কাগজপত্রও নেই।

Advertisement

সুব্রত গুহ

কাঁথি শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০৭
Share:

সৈকতের ধার ঘেঁষেই মাথা তুলেছে হোটেল। মন্দারমণিতে সোহম গুহর তোলা ছবি।

নিষেধাজ্ঞা না মানাটাই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

Advertisement

আইনের তোয়াক্কা না করেই সমুদ্রের একশো মিটারের মধ্যেই গজিয়ে উঠেছে হোটেল-লজ। সৈকত পর্যটন কেন্দ্র মন্দারমণির কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় সৈকতের ধারের ৮৫টি হোটেলের মধ্যে ৩১টি হোটেলই গড়ে উঠেছে পাট্টা দেওয়া জমির উপর। পাঁচটি হোটেল মালিকের কাছে নির্মাণের কোনও বৈধ কাগজপত্রও নেই।

সিআরজেড (কোস্টাল রেগুলেশন জোন) বিধি অনুযায়ী সমুদ্রের পাঁচশো মিটারের মধ্যে কোনও ধরনের নির্মাণ কাজ করা আইনবিরুদ্ধ। গত অক্টোবরে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মন্দারমণির ওই হোটেলগুলির কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে বলা হয়। সেই মতো গত নভেম্বর মাসে ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে নোটিস জারি করে হোটেল-লজ মালিকদের নির্মাণের অনুমতির কাগজপত্র দেখানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। সম্প্রতি জেলা প্রশাসন ও দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ (ডিএসডিএ)-কে দেওয়া রামনগর-২ ব্লকের বিডিও-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমুদ্র সৈকতে ভূমিহীনদের পাট্টা দেওয়া জমিতে অবৈধ ভাবে ২৬টি হোটল-লজ তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও পাঁচটি লজ নির্মাণের জন্য রামনগর-২ পঞ্চায়েত সমিতি ও ডিএসডিএ-র থেকে কোনও অনুমতি নেওয়া হয়নি।

Advertisement

মূলত বসবাস ও চাষবাসের কাজে ব্যবহারের জন্য দরিদ্র ভূমিহীন পরিবারকে সরকারি খাস জমি পাট্টা দেওয়া হয়ে থাকে। পাট্টায় পাওয়া জমি কাউকে হস্তান্তর করা যায় না। এমনকী ওই জমিতে বাণিজ্যিক কাঠামো নির্মাণও নিয়মবিরুদ্ধ। পাট্টাপ্রাপকরাই একমাত্র তাঁদের জমিতে চাষবাস করা বা বসতবাড়ি তৈরি করতে পারেন। তা সত্বেও ২০০৫-২০১১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে পাট্টা দেওয়া জমিতেই হোটেল তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন উঠছে, স্থানীয় পঞ্চায়েত কীভাবে পাট্টা দেওয়া জমিতে হোটেল তৈরির অনুমতি দিল?

কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন বাম প্রধান অশোক মাইতি দাবি করেন, এক শ্রেণির হোটেল ব্যবসায়ী কৌশলে জমির বেশি দাম দেওয়ার লোভ দেখিয়ে পাট্টাপ্রাপ্তদের নিজেদের ব্যবসার অংশীদার করে নেয়। পাট্টাপ্রাপ্তদের হোটেল ব্যবসার এক-দশ শতাংশ শেয়ারের অংশীদার হিসেবে দেখিয়ে হোটেল মালিকরা দলিলও তৈরি করে। সেই দলিল দেখিয়ে পাট্টা দেওয়া জমিতে হোটেল তৈরির অনুমতি চাইলে পঞ্চায়েত অনুমোদন দিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে হোটেল ব্যবসায়ীদের কাছে আদালতের কাগজ থাকায় সব কিছু জেনেও পঞ্চায়েতের কিছু করার থাকে না।

মন্দারমণিতে সমুদ্র সৈকতের ধারে পাট্টা পাওয়া মৎস্যজীবী একাদশী মণ্ডল, শ্রীনিবাস জানা, বনবিহারী দাসদের কথায়, “পাট্টা পাওয়া জমি কোনও কাজে আসছিল না। অন্য দিকে হোটেল মালিকরা ভাল দাম দিয়ে জমি কেনা ছাড়াও হোটেল ব্যবসায় আমাদের অংশীদারও করে নিয়েছেন। একইসঙ্গে, হোটেলগুলিতে বাড়ির বেকার ছেলেদের কাজের ব্যবস্থাও হয়েছে। ফলে জমি দিয়ে আর্থিক দিক থেকে আমরা উপকৃতই হয়েছি।” কাঁথি মহকুমা মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ জানাও বলেন, “সরকারের কাছ থেকে মন্দারমণি মৌজায় এক একর খাসজমি পাট্টায় পেয়েছিলাম। কিন্তু সৈকতের ধারে বালিয়াড়ি বেষ্টিত ওই জমিতে চাষের কাজ করা যায় না। ওই জমিতে বসতবাড়ি তৈরির মতো আর্থিক সঙ্গতিও আমার নেই।” তাঁর বক্তব্য, “উপকূলে মৎস্যশিকার করে তেমন আয় হয় না। তাই ওই জমি হোটেল মালিককে বিক্রি করে দিয়েছি। বর্তমানে ওই জমিতে হোটেল তৈরিও হয়ে গিয়েছে।”

ডিএসডিএ-এর চেয়ারম্যান শিশির অধিকারী জানান, ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দিঘায় সৈকত উৎসবের উদ্বোধন করতে এসে মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতও পরিদর্শন করেন। সেই সময় সৈকতের ধারে গড়ে ওঠা হোটলগুলি দেখে ক্ষুব্ধ হন মুখ্যমন্ত্রী। তখনই মুখ্যমন্ত্রী মন্দারমণিতে হোটেল নির্মাণের অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের হাত থেকে নিয়ে ডিএসডিএ-কে দেন। তারপর থেকে মন্দারমণিতে ডিএসডিএ কোনও হোটেল-লজ নির্মাণের অনুমোদন দেয়নি। শিশিরবাবু বলেন, “মন্দারমণিতে ব্লক প্রশাসনের চিহ্নিত ৩১টি হোটেল ও লজগুলির বিষয়ে রাজ্য সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মন্দারমণি বিচ হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দেবদুলাল দাসমহাপাত্র বলেন, “স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে অনুমোদন নিয়েই তো মন্দারমণিতে হোটেল-লজ তৈরি করা হয়েছে। তখন কেন পাট্টা দেওয়া জমিতে হোটেল নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হল?” তৎকালীন গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমোদন নিয়ে তৈরি হওয়া হোটেলের বিরুদ্ধে বর্তমান প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেক হোটেল মালিক। প্রয়োজনে আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন তাঁরা।

কালিন্দী গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান তসলিমা বিবি জানান, বিগত বাম আমল থেকেই মন্দারমণি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। তবে মন্দারমণিতে সিআরজেড নিয়ে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে এখনও সেখানে ‘হাই টাইড’ ও ‘লো টাইড লাইন’ নিয়ে কোনও মাপজোক করা হয়নি। অবিলম্বে সেই মাপজোকের ব্যবস্থা করা উচিত। অন্য দিকে, দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের সম্পাদক দেবাশিস শ্যামল জানিয়েছেন, মন্দারমণিতে সৈকতের ধারে পাট্টা দেওয়া জমির উপর অবৈধ ভাবে গড়ে ওঠা হোটেলগুলি ভেঙে ফেলার জন্য ইতিমধ্যে ফোরামের পক্ষে জেলা প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন