কর্মিসভার পথে সন্ধ্যা রায়। মেদিনীপুরের এক লজে। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ
দলের সাংগঠনিক সভাতেই ধেয়ে এল চাঁচাছোলা প্রশ্নগুলো। কোনও নেতা জিজ্ঞাসা করলেন, “দিদি, আপনি কত দিন সময় দিতে পারবেন? সকলে আপনাকে দেখতে চাইছে।” আর এক নেতা বললেন, “কর্মিসভায় আমাদের কথা শুনতে হচ্ছে। আপনি সময় দিলে আমরা বিধানসভা এলাকা ধরে ধরে কর্মসূচি ঠিক করতে পারি।”
শনিবার দুপুরে মেদিনীপুর শহরের একটি লজে দলীয় সভায় এ সব শুনে তৃণমূলের তারকা প্রার্থী সন্ধ্যা রায় কিছুটা থতমত খেয়ে যান। পরে অবশ্য পরিস্থিতি সামলে নেন অভিনেত্রী। স্পষ্ট ভাষায় নেতা-কর্মীদের বলেন, “আমি অন্য জগতের মানুষ। বয়সও হয়েছে। কলকাতা থেকে এসে ও ভাবে ঘুরতে পারব না। আপনারা যদি প্রচারে আমাকে অল্প ব্যবহার করেন, সুবিধে হয়। আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায়কেও এ কথা জানিয়েছি। ওঁরা বলেছেন, সকলে মানিয়ে নেবে।”
পরে কিছুটা অভিমানী শোনায় সন্ধ্যাদেবীর গলা। তিনি বলেন, “একজন বললেন, কেন আগে আসার কথা থাকলেও আমি এলাম না। ইচ্ছে করে আসিনি, তা নয়। কেশিয়াড়ির সভায় ৪ ঘন্টা মঞ্চে বসে থাকলাম। কেউ একবারও বললেন না, নীচে এসে বসুন। আমার জ্বর হয়ে গেল। ডাক্তার মেদিনীপুরে আসতে মানা করেছিলেন। তা-ও এলাম। তাই ওই কথাটা শুনে কষ্ট হল।”
দলীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এরপর অবস্থা সামাল দিতে উঠে-পড়ে লাগেন জেলা নেতারা। দলের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা চেয়ারম্যান নেতা-কর্মীদের বুঝিয়ে বলেন, “প্রার্থী কতটা প্রচারে সময় দিতে পারল, সেটা বড় কথা নয়। প্রার্থীর ব্যবহারটাই আসল। আমাদের প্রার্থী দেবীর মতো!” সন্ধ্যাদেবীর প্রতিপক্ষ মেদিনীপুরের বাম প্রার্থী প্রবোধ পণ্ডা এলাকা চষে বেড়ালেও বিশেষ লাভ হবে না বলে কর্মীদের জানান মৃগেনবাবু। আর জেলা তৃণমূল সভাপতি দীনেন রায়ের ব্যাখ্যা, “আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোট হবে তাঁকে সামনে রেখে, দলকে সামনে রেখে।”
সভার পরে অবশ্য ক্ষোভ-অসন্তোষ নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাননি জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। মৃগেনবাবুকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি শুধু বলেন, “তেমন কিছু হয়নি তো! সাংগঠনিক সভায় তো কিছু প্রশ্ন উঠবেই। তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।” এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “সন্ধ্যাদির শরীরটা ভাল নেই। তা ছাড়া রাজনীতিতে নতুন বলে উনি এখনও কুশলী কথাবার্তায় রপ্ত হননি। এটাও ঠিক যে ওই কেন্দ্রে নেতা-কর্মীদেরই প্রচারের ভার সামলাতে হবে।” একই সঙ্গে পার্থবাবু জানিয়েছেন, সন্ধ্যাদেবীর সঙ্গে কথা বলেই তাঁর প্রচার-সূচি ঠিক করা হবে।
মার্চ মাসের গোড়ায় তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষিত হয়েছে। তারপর ১৮ মার্চ মেদিনীপুর অরবিন্দ স্টেডিয়ামের কর্মিসভায় এসেছিলেন সন্ধ্যাদেবী। পরে কলকাতা ফিরে যান। তারপর ৩১ মার্চ আসেন মমতার সঙ্গে। মমতা সে দিন তিনটি সভা করলেও কেশিয়াড়িতে প্রথম সভা সেরেই কলকাতা চলে যান সন্ধ্যাদেবী। তৃণমূল সূত্রে খবর, ওই দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন সন্ধ্যাদেবী। অসুস্থতার জন্য পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ৩ এপ্রিল থেকে প্রচারও শুরু করতে পারেননি তিনি। অবশেষে শুক্রবার নারায়ণগড়ে কর্মিসভা দিয়ে তাঁর প্রচার শুরু হয়।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, প্রার্থীকে প্রচারে না পাওয়ায় একাংশ নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এ দিনের সভায় তাই সামনে এসেছে। মেদিনীপুর লোকসভার অধীন ৭টি বিধানসভা এলাকার নেতাদের সঙ্গে প্রার্থী পরিচয় করাতে এ দিন বেলা ১২টা নাগাদ সভা শুরু হয়। সন্ধ্যাদেবী আসেন দুপুর ১টায়। তৃণমূল সূত্রের খবর, গোড়াতেই দলের খড়্গপুর শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী সন্ধ্যাদেবীকে বলেন, “মানুষ আপনাকে দেখতে চায়। কর্মিসভায় গিয়ে আমাদের এ কথা শুনতে হচ্ছে। ৭টি বিধানসভার জন্য আপনি কতদিন সময় দেবেন বললে ভাল হয়।” এমন প্রশ্নে প্রার্থী এবং জেলা নেতারা অসন্তুষ্ট হচ্ছে বুঝে দেবাশিসবাবু বলেন, “এটা সাংগঠনিক সভা। মনের কথা এখানে বলব না তো কোথায় বলব?” খড়্গপুরের আর এক নেতা নারায়ণ পড়িয়া তো সোজাসুজি দাবি করেন, “প্রার্থীকে প্রচারে বেশি সময় দিতে হবে।” তৃণমূলের শালবনি ব্লক সভাপতি নেপাল সিংহও বলে ওঠেন, “জঙ্গলমহলের মানুষ সন্ধ্যাদিকে একবার চোখের দেখা দেখতে চান।”
এ দিনের সভায় চাপা থাকেনি তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দলও। খড়্গপুর শহরে দলের শহর সভাপতি দেবাশিস চৌধুরী এবং প্রাক্তন পুরপ্রধান জহরলাল পালের অনুগামীদের বিরোধ সকলেরই জানা। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিন দেবাশিসবাবু দলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে বলে অনুযোগ করেন। জহরবাবুও বলেন, “খড়্গপুর শহরে দলে বিভাজন রয়েছে। এটা জেলা নেতৃত্বেরও জেনে রাখা দরকার।”
একে অস্বস্তিকর প্রশ্ন, তায় দলের কোন্দল সব মিলিয়ে তারকা প্রার্থীর অভিজ্ঞতা নেহাত ভাল হল না।