আজ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস

প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে সফল অরিন্দমকে সম্মান

চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসায় বাবা-মা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সে সবে তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। শুধু তাই নয়, তমলুকের প্রত্যন্ত গ্রামের অরিন্দম মণ্ডলকে লড়াই করতে হয়েছিল দারিদ্রের সঙ্গেও। তবে হার মেনে পিছিয়ে আসেনি সে। পড়াশোনার সঙ্গে সাঁতার নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করত অরিন্দম। সেই পরিশ্রমের সুফল হিসেবেই জাতীয় স্তরের সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০ টি সোনার পদক বছর ষোলোর ওই কিশোরের ঝুলিতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

তমলুক শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:২০
Share:

অরিন্দম মণ্ডল। —নিজস্ব চিত্র।

চোখের দৃষ্টি ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসায় বাবা-মা তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন সে সবে তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া। শুধু তাই নয়, তমলুকের প্রত্যন্ত গ্রামের অরিন্দম মণ্ডলকে লড়াই করতে হয়েছিল দারিদ্রের সঙ্গেও। তবে হার মেনে পিছিয়ে আসেনি সে। পড়াশোনার সঙ্গে সাঁতার নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করত অরিন্দম। সেই পরিশ্রমের সুফল হিসেবেই জাতীয় স্তরের সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০ টি সোনার পদক বছর ষোলোর ওই কিশোরের ঝুলিতে। বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে তাকে সংবর্ধনা দেবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন।

Advertisement

তমলুক শহরের পাঁচ কিলোমিটার দূরে হলদিয়া-মেচেদা ৪১ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে কাকগেছিয়া বাজার থেকে আরও প্রায় দু’কিলোমিটার দূরের গ্রাম জলি গোবিন্দপুর। গ্রামের বাসিন্দা অশোক মণ্ডল পেশায় ভ্যান চালক। মাটির দেওয়াল আর টালির চালের বাড়িতে স্ত্রী সুষমাদেবী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে অরিন্দমকে নিয়ে কোনওরকমে চলে সংসার। অরিন্দমের দিদির বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বোন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। চার জনের পরিবারের হাল সামলাতে তিন মাস আগে অশোক মণ্ডল ছত্তীসগঢ়ে একটি কারখানায় কাজ করতে গিয়েছেন। মা সুষমা মণ্ডল দুই ছেলে-মেয়েকে দেখাশোনার পাশাপাশি দিনমজুরির কাজও করেন। সুষমাদেবী বলেন, “অরিন্দমের চোখের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আমাদের আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় ভাল ভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারছি না। চিকিৎসার জন্য তমলুকে জেলা হাসপাতালের বহির্বিভাগই ভরসা।”

আর পাঁচটা শিশুর মতো অরিন্দমকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিও করা হয়েছিল। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে আসার বিষয়টি নজরে আসে। অরিন্দমের বাবা-মা তমলুকের এক চিকিৎসকের কাছে ছেলেকে নিয়ে যান। কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। তবে অরিন্দমের পড়াশোনা বন্ধ হয়নি।

Advertisement

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর স্থানীয় একটি হাইস্কুলে সে ভর্তি হয়। চোখে ভাল দেখতে না পাওয়ায় পড়াশোনা করতে তার অসুবিধ া হত। ২০১১ সালে তমলুকের নিমতৌড়ি তমলুক উন্নয়ন সমিতি পরিচালিত প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে অরিন্দমকে ভর্তি করা হয়। ওই স্কুলের ছাত্র থাকার সময় সাঁতারের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। এরপরে রাজ্য ও জেলা স্তরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজের দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে সে একাধিক পদক জয় করে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মহারাষ্ট্রের কোলাপুরে জাতীয় প্যারা অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অরিন্দম ৫০ মিটার ফ্রি স্টাইল, ৫০ মিটার ব্যাক স্ট্রোক ও ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনটি সোনার পদক জয় করে। ২০১৩ সালে কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে জাতীয় প্যারা অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনটি সোনার পদক জেতে সে।

গত নভেম্বরে ইন্দোরে জাতীয় প্যারা অলিম্পিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অরিন্দম ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল ও ১০০ মিটার বাটার ফ্লাই বিভাগে প্রথম হয়ে দু’টি সোনার পদক পায়। ধারাবাহিক সাফল্যে অনুপ্রাণিত ওই গ্রামের দুই কিশোর সূর্য মণ্ডল ও শুভাশিস মণ্ডল। তারাও এখন গ্রামের পুকুরে অরিন্দমের সঙ্গে সাঁতারের অনুশীলন করছে। দশম শ্রেণির পড়ুয়া সূর্যের কথায়, “অরিন্দমকে দেখেই আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দিচ্ছি।” অরিন্দমের আক্ষেপ, “সাঁতার শেখার জন্য সুইমিং পুল পাইনি। ভাল পুকুর নেই, যেখানে সাঁতার শিখব।”

সাফল্যের দরজা খুললেও কমেনি দারিদ্রতা। আর্থিক দুরবস্থার কারণে এক বছর পড়াশোনাও বন্ধ ছিল। ফের বাড়ির কাছে কাকগেছিয়া সত্যনারায়ণ হাইস্কুলের নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছে অরিন্দম। অরিন্দম বলে, “আন্তর্জাতিক স্তরের সাঁতার প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে সোনার পদক জেতাই আমার পরবর্তী লক্ষ্য। আমি চাই, পরিবারের দুর্দশা ঘোচানোর জন্য স্থায়ী রোজগারের ব্যবস্থা করা হোক। জানি না, কতদিনে আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন