নগরায়ণের পথে পাঁশকুড়া। মেচগ্রামের কাছে। —নিজস্ব চিত্র।
এক যুগেরও বেশি সময় হল এলাকা পুরসভায় উত্তীর্ণ হয়েছে। রাজ্যের আর পাঁচটা জায়গার মতো শুরু হয়ে গিয়েছে নগরায়ণও। কিন্তু, নাগরিক পরিষেবায় উন্নতির লক্ষণ নেই পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায়।
হাওড়া থেকে মুম্বইগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের কাছে পুরাতন বাজার এবং খড়্গপুরগামী রেলপথে পাঁশকুড়া স্টেশন সংলগ্ন বাজারকে কেন্দ্র করে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছিল আগেই। দীর্ঘ দিন ধরে এলাকাগুলি পঞ্চায়েতের অধীনে ছিল। নাগরিক পরিষেবা ছিল না বললেই চলে। জনপ্রতিনিধিরাও পাঁশকুড়ার এই এলাকাকে পুরসভায় উন্নীত করার দাবি জানিয়ে আসছিল বহু দিন ধরেই। শেষমেষ ২০০২ সালে গঠিত হয় পাঁশকুড়া পুরসভা। পাঁশকুড়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েত, পাঁশকুড়া ১, প্রতাপপুর ১, ২ পঞ্চায়েতের অধীনে থাকা স্টেশনবাজার, পুরাতন বাজার ও সংলগ্ন কিছু এলাকা নিয়ে তৈরি হয় ১৭ ওয়ার্ড বিশিষ্ট জেলার নবীনতম এই পুরসভা। তখন এলাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ হাজার।
পুরসভায় উত্তীর্ণ হওয়ায় নাগরিক পরিষেবা বাড়বে, এই আশায় এলাকায় জনবসতি দ্রুত হারে বাড়তে শুরু করে। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী পুর এলাকার জনসংখ্যা ছিল ৫৩ হাজারের মত। মাত্র তিন বছরেই তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজারে। পুরপ্রধান জাকিউর রহমান খান জানাচ্ছেন, “তিন-চার বছর আগেও ওয়ার্ড পিছু জনসংখ্যা ছিল গড়ে ৩ হাজার। এখন তা ৪ হাজারেরও বেশী। বাইরে থেকে অনেক নতুন বাসিন্দা আসায় দ্রুত জনসংখ্যা বাড়ছে।”
শুধু পাঁশকুড়া পুরসভা এলাকা নয়, সংলগ্ন মেচগ্রাম এলাকাতেও দ্রুত জনবসতি বাড়ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের মত, রেল ও সড়কপথে কলকাতা-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার জন্য পাঁশকুড়া জেলার বাসিন্দাদের কাছে তো বটেই, পাশের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার একাংশের কাছেও আকর্ষণীয় হচ্ছে। ফলে এখন পাঁশকুড়া পুরাতন বাজার ও রেলস্টেশন ছাড়িয়ে মেচগ্রাম এলাকায় শুরু হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের নগরায়ণ। খড়্গপুরগামী ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে পাঁশকুড়ার কাঁসাই সেতুর কাছ থেকে মেচগ্রাম পর্যন্ত এলাকা তো বটেই, পাঁশকুড়া রেলস্টেশন থেকে ঘাটালগামী সড়কের সংযোগস্থলে মেচগ্রামের কাছে গড়ে উঠেছে একাধিক ফ্ল্যাট। মেচগ্রামের কাছাকাছি রয়েছে জেলার অন্যতম বড় কলেজ পাঁশকুড়া বনমালী কলেজ, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে তিনটি বিএড কলেজ, একাধিক সরকারি-বেসরকারি বাংলা ও ইংরাজি মাধ্যমের স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, হাসপাতাল, বাজার থেকে আধুনিক অতিথিশালা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট। গাড়ি চলাচলের সুবিধার জন্য মেচগ্রামের কাছে ৬ লেনের জাতীয় সড়কের উপর তৈরি হচ্ছে ফ্লাইওভার।
ফলে পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরে মেচগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে ‘নিউ পাঁশকুড়া উপনগরী’। এই সব এলাকায় জমির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এলাকার এক বাসিন্দা জানান, কয়েক বছর আগেও পাকারাস্তার ধারে প্রতি ডেসিমল জমির দাম ছিল পঞ্চাশ থেকে আশি হাজার টাকা। এখন তা পাঁচ-ছ’লক্ষ টাকায় পৌঁছেছে। ফ্ল্যাট বর্গফুট প্রতি তিন হাজারেরও বেশি!
জনপদে নগরায়ণের ঢেউ লাগলেও নাগরিক পরিষেবা বেহাল চিত্র নিয়ে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। পুরসভার এলাকার অর্ন্তগত পুরনো জনপদ প্রতাপপুর, রানিহাটি, গড় পুরুষোত্তমপুর, চাঁপাডালি, সুরানানকার, বালিডাংরি, নারান্দা, দক্ষিণ গোপালপুরের মতো অনেক এলাকায় শহরের ছাপ লাগেনি বলে অভিযোগ। পুরসভার তরফে পাকা রাস্তা তৈরি হলেও নিকাশি ভাল ভাবে গড়ে ওঠেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। পুরসভা এলাকার মধ্যে থাকা সত্বেও ভবানীপুর, পশ্চিম কল্লা, জন্দড়া, তিলন্দপুর এলাকা আর পাঁচটা গ্রামের চেয়ে আলাদা নয়। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, স্টেশন বাজার সংলগ্ন ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কিছু এলাকা, নারান্দা এলাকায় ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মাস্টার কলোনি, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে নিউ মাস্টার কলোনি এলাকায় বহু নতুন বাড়ি তৈরি হলেও রাস্তাঘাট, পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি তেমন হয়নি।
অপরিকল্পিত ভাবে শহর বেড়ে চলার অভিযোগও রয়েছে। পুরসভা বা পঞ্চায়েত সমিতির নজরদারি নেই বলেও তাঁরা জানাচ্ছেন। নতুন বাড়ি বা ফ্ল্যাট করার সময় নিকাশি বা গাড়ি ঢোকার মতো পর্যাপ্ত জায়গা ছাড়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ তাঁদের। এর জেরে ইতিমধ্যেই পাকারাস্তা, নিকাশি তৈরি, বিদ্যুৎ ও জলের পাইপলাইন পাতার ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হতে শুরু করেছেন শহরের বাসিন্দারা। এখনই গুরুত্ব না দিলে আরও দুর্ভোগ অপেক্ষা করছে, মত তাঁদের।
শহরের বাসিন্দাদের আরেক’টি বড় সমস্যা স্টেশনের কাছে ঘাটালগামী সড়কে রেলের লেভেল ক্রসিং পার হওয়া। ছাত্র-ছাত্রী সহ হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে বাসে, মোটর বাইকে, সাইকেলে আটকে পড়েন। দীর্ঘ দিন ধরেই ফ্লাইওভার তৈরির জন্য দাবি উঠলেও তা পূরণ হয়নি। পাঁশকুড়ার বাসিন্দা তথা জলসম্পদ মন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র বলেন, “ফ্লাইওভার তৈরির দাবি খুবই সঙ্গত। এ বিষয়ে চেষ্টা করছি। আশাকরি দ্রুত সমাধান হবে।”
শহরের বসতি এলাকায় জঞ্জাল সাফাই করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হলেও, এখনও চালু করতে পারেনি পুরসভা। শহরের সব রাস্তায় পথবাতির ব্যবস্থাও নেই। সন্ধে নামতেই কিছু এলাকা অন্ধকারে ডুবে যায়। বাসিন্দাদের পানীয় জলের ভরসা সাব-মার্সিবল পাম্প দিয়ে তোলা জল। জল প্রকল্পের কাজ কবে শেষ হবে তা নিয়েও সংশয়ে শহরবাসী। পুরসভা গঠনের আগে পাঁশকুড়া পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে বিডিও অফিসের কাছে রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ ও পাশেই একটি শিশুউদ্যান তৈরি হলেও আর নতুন কোনও হল কিংবা পার্ক, খেলার মাঠ গড়া হয়নি বলে অভিযোগ।
নগরবাসীর নানাবিধ সমস্যার কথা অজানা নয় পুরপ্রধানের। জাকিউর রহমান খান বলেন, “বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে পাশাপাশি দু’টি বাড়ির দূরত্ব পুর নিয়মনুযায়ী রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। জলপ্রকল্পের কাজ চলছে। ডিসেম্বরের মধ্যে বাড়িতে পানীয় জলের সংযোগ পৌঁছে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। উন্নত নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।” একই সঙ্গে তিনি বলছেন, “পুরসভার সংলগ্ন মেচগ্রাম এলাকাকে পুরসভার আওতায় আনার জন্য প্রস্তাব পাঠানো হবে।”
মেচগ্রামে কি অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ি-ফ্ল্যাট হচ্ছে? পাঁশকুড়া পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সুজিত রায় বলেন, “ঘরবাড়ি পরিকল্পিত ভাবে হলেও রাস্তা, নিকাশি নালা ঠিক মতো হচ্ছে না।” তাঁর সাফাই, পাঁশকুড়া এলাকা সম্প্রতি হলদিয়া উন্নয়ন পর্ষদের আওতায় এসেছে। ফলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়েছে। সমস্যাগুলি নিয়ে পরিকল্পনা বৈঠক হবে, জানান তিনি।
কেমন লাগছে আমার শহর?
নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু
বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর মেদিনীপুর’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,
পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।