মত আইআইটি-র গবেষকদের

পর্বত তৈরির প্রক্রিয়াতেই জন্ম আর্সেনিকের

আর্সেনিক থেকে মুক্তির উপায় নেই। কারণ আর্সেনিকের জন্ম হঠাৎ করে হয়নি। অনন্তকাল ধরে পর্বত তৈরির প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াতেই আর্সেনিকের উৎপত্তি হয়েছে এবং ক্রমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি করলেন গবেষকরা। গবেষকদের মতে, অনন্তকাল ধরেই পর্বত সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির গভীরে থাকা আর্সেনিক উঠে আসছে উপরে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৫ ০০:৩৭
Share:

আর্সেনিক থেকে মুক্তির উপায় নেই। কারণ আর্সেনিকের জন্ম হঠাৎ করে হয়নি। অনন্তকাল ধরে পর্বত তৈরির প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াতেই আর্সেনিকের উৎপত্তি হয়েছে এবং ক্রমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি করলেন গবেষকরা। গবেষকদের মতে, অনন্তকাল ধরেই পর্বত সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাটির গভীরে থাকা আর্সেনিক উঠে আসছে উপরে। তারপর পাহাড়ি নদী বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে। যার ফল, সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা (হিমালয়, ভারতীয় উপমহাদেশ), চাকো-পাম্পিয়ান অববাহিকা (আন্দিয়ান, আর্জেন্টিনা, চিলি, বলিভিয়া), রকি পার্বত্য বেসিন (ওয়েস্টার্ন করডিল্লেরাল, আমেরিকা ও কানাডা), নিউ ইংল্যান্ড এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় যুক্তরাষ্ট্র (অ্যাপালেচিয়ান)— এই সব জায়গার ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক মেলে। প্রখ্যাত পুস্তিকা ‘জর্নাল অব হাইড্রোলজি’-তে সম্প্রতি এই গবেষণা প্রকাশিতও হয়েছে।

Advertisement

কী ভাবে ‘টেকটনিক প্লেট’ থেকে বেরিয়ে আসছে আর্সেনিক, কী ভাবেই তা হাজার হাজার ফুট নীচ থেকে উঠে আসছে উপরে, মিশে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলে- তা নিয়েই গবেষনা চালিয়েছিলেন খড়্গপুর আইআইটির জিওলজি ও জিওফিজিক্স বিভাগের অধ্যাপক অভিজিত্‌ মুখোপাধ্যায় ও শৈবাল গুপ্তের সঙ্গে আমেরিকার কেনটাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লায়েড রিসার্চের গবেষক কেভিন আর হেনকে, সুইডেনের রয়্যাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির ভূগর্ভস্থ আর্সেনিক সংক্রান্ত গবেষণা দলের সদস্য প্রসূন ভট্টাচার্য ও আইআইটির গবেষক ছাত্রী স্বাতী ভার্মা। গবেষকদের মতে, হঠাত্‌ করেই আর্সেনিকের জন্ম হয়নি। প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক নিয়মেই প্রাচীনকাল থেকেই আর্সেনিক জন্ম নিচ্ছে ও তা ছড়িয়ে পড়ছে। কেন বিশ্বের নির্দিষ্ট কয়েকটি নদী আববাহিকা জুড়েই আর্সেনিকের প্রকোপ? এই ভাবনা থেকেই গবেষণার জন্ম। গবেষক তথা খড়্গপুর আইআইটির জিওলজি ও জিওফিজিক্স বিভাগের শিক্ষক অভিজিত্‌ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “কেনই বা নির্দিষ্ট কয়েকটি নদী অববাহিকা ধরেই আর্সেনিকের প্রকোপ, তা নিয়ে তেমন কোনও তথ্য মিলছিল না। তখনই আমরা কয়েকজন মিলে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করি। তা করতে গিয়েই দেখি, ভূতাত্তিক নিয়মে পর্বত তৈরির প্রক্রিয়া থেকেই নানা বিক্রিয়ায় আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমাগত ধাক্কা মারতে মারতে মাটির আরও গভীরে ঢুকে যাওয়া দৈত্যকার টেকটনিক প্লেটে থাকা আর্সেনিকই (যে ভাবে এখনও তৈরি হচ্ছে হিমালয়) ছড়িয়ে পড়ছে নদী অববাহিকা ধরে।’’

কী ভাবে এই আর্সেনিক শক্ত ও বৃহত্‌ টেকটনিক প্লেট থেকে অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে নিজেকে মুক্ত করে উপরে উঠছে। গবেষকদের মতে, ক্রামগত মাটির গভীরে থাকা শক্ত প্লেটটি প্রতিনিয়ত মাটির আরও গভীরে ঢুকতে চায়। প্রচণ্ড চাপে নীচে ঢুকতে যাওয়ার ফলে তৈরি হয় ঘর্ষণ। যা থেকে জন্ম নেয় ন্যূনতম ৬৫০-৭০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা। যে তাপমাত্রায় শক্ত প্লেটও তরল হয়ে যায়। তখনই অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে বেরিয়ে আসে আর্সেনিকও। আর্সেনিকের প্রকৃতিই হল উপরের দিকে ওঠার প্রবনতা। তাই এই আর্সেনিক এক ভূতাত্ত্বিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পাশে থাকা ম্যান্টেলগুলিকে আংশিক দ্রবীভূত করে। ম্যান্টেলের সিলিকেট খনিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না হলেও ম্যান্টেল ওয়েজের কিছু সালফাইডের সাথে আংশিক গলিত অবস্থায় থেকে যায়। এই গলিত তরলই এক ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে। যে সব নদী অববাহিকাতে আর্সেনিক মেলে, সেই নদীর উত্‌পত্তিস্থল যে পর্বত বা পর্বতমালা, সেখানে এই প্রক্রিয়াতেই আর্সেনিক উঠে এসেছিল। ফলে যে পর্বতমালা তৈরির কাজ অনেক আগেও শেষ হয়ে গিয়েছিল, সেখান থেকে এখনও আর্সেনিক মেলে। কারণ, এই প্রক্রিয়াটি অতি শ্লথ। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘটে চলে। অভিজিত্‌বাবুর কথায়, “এই কারণেই গঙ্গা-ব্রম্ভপুত্র-সিন্ধু (যাদের উত্‌স হিমালয়) অববাহিকায় যেমন আর্সেনিক মেলে তেমনই ওয়াইহো (উত্‌স অ্যাপালেচিয়ান, যার তৈরি প্রক্রিয়া বহুদিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল) নদীতেও (ইউএসএ) আর্সেনিক মেলে।’’

Advertisement

গঙ্গা-সিন্ধু-ব্রহ্মপুত্র তো বটেই চিনের ইয়োলো, কাম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের নিকং, মায়ানমারের ইরাবতী-সহ বিভিন্ন নদী অববাহিকাতেও আর্সেনিক মেলে। গবেষকদের মতে, যেহেতু এই প্রক্রিয়া বন্ধ করা সম্ভব নয়, তাই আর্সেনিককেও আটকে রাখা যাবে না। উল্টে যত দিন যাবে এই প্রাকৃতিক ভূতাত্বিক প্রক্রিয়াতেই ভূগর্ভস্থ জলে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে আর্সেনিক। যা থেকে মুক্তি পেতে হলে একমাত্র উপায় কারিগরি প্রযুক্তি। যার মাধ্যমে জল পরিস্রুত করে পান করতে হবে। না হলে আর্সেনিকের করাল গ্রাস থেকে এই সব নদী অববাহিকার মানুষকে বাঁচানো সম্ভব নয় বলেই গবেষকদের মত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন