অবহেলায় পড়ে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বিষ্ণু মন্দির
বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলি, তবে জানবি চন্দ্রকোনা এলি— চন্দ্রকোনায় আসা যে কোনও আগন্তুক এখনও প্রবাদটির সঙ্গে ১৪৬ বছরের পুরনো পুর-শহরের মিল পাবেন।
১৮৬৯ সালে পুরসভার তকমা পায় চন্দ্রকোনা। পুরনো এই ঐতিহাসিক শহরটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে শতাধিক মন্দির। এর মধ্যে বহু মন্দিরে রয়েছে টেরাকোটার কাজ। মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ রয়েছে লিপি। রয়েছে রাজবাড়িও। শহর সংলগ্ন অন্যতম দ্রষ্টব্য জায়গা হল ফাঁসিডাঙা (ইংরেজ আমলে এখানে ফাঁসি দেওয়া হত), লালসাগর কিংবা ধামকুড়া। এগুলি পিকনিকের জায়গা হিসাবেও জনপ্রিয়। আর রয়েছে উন্মুক্ত প্রকৃতি। স্থানীয়দের একাংশের মতে, পুরসভা কিংবা প্রশাসন উদ্যোগী হলে জঙ্গলমহল সংলগ্ন এমন জনপদের পর্যটন-সম্ভাবনা যথেষ্টই।
চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে প্রথমে চন্দ্রকোনায় ক্ষমতায় আসে মল্ল রাজারা। মল্লদের ক্ষমতাচ্যুত করে পরবর্তী কালে রাজসিংহাসনে বসেন কেতু বংশের রাজারা। কেতু বংশের রাজা চন্দ্রকেতু দীর্ঘ সময় শাসন করেছিলেন চন্দ্রকোনায়। এই জনপদের নামকরণ নিয়ে প্রামাণ্য নথি নেই। জনশ্রুতি, রাজা চন্দ্রকেতুর নামেই এই এলাকার নাম হয় চন্দ্রকোনা। শহরের ইতিহাস থেকে জানা যায়, কেতু বংশের রাজাদের আমলেই জঙ্গল পরিবৃত জনপদ সেজে ওঠে। সেই সময়ে শহরে গড়ে ওঠে একাধিক মন্দিরও। লৌকিক দেবদেবী থেকে শুরু করে রাম মন্দির, সতী মন্দির, বিষ্ণু, শিব-সহ চারশোরও বেশি মন্দির ছিল পুর-শহরে।
এ জন্য চন্দ্রকোনা ‘মন্দিরের শহর’ বলেও পরিচিত। পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বীরভান বংশের রাজারা চন্দ্রকোনার অধিপতি হন। মল্ল এবং কেতু বংশের রাজত্ব কালে কিছু মন্দির তৈরি হলেও, অধিকাংশ মন্দিরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বীরভানের আমলে। মন্দিরগুলির টেরাকোটার কাজ মুগ্ধ করত পর্যটকদের। বর্তমানে শহরের অনেক মন্দিরই ধ্বংসের পথে। শোনা যায়, পুরীর পথে স্বয়ং গুরুনানক এক রাত কাটিয়েছিলেন চন্দ্রকোনায়। তার সাক্ষ্য দেয় শহর সংলগ্ন রামগড়ের নানক মন্দির। ঠাকুরবাড়ি বাজার, গোঁসাইবাজার, অস্থল, মিত্রসেনপুর, সতীবাজার, গোপসাই এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এখনও শতাধিক মন্দির রয়েছে। ষোড়শ শতকে বর্ধমানের রাজারা ক্ষমতায় আসেন। চন্দ্রকোনা নিয়ে একাধিক গবেষণামূলক বই লিখেছেন শহরেরই বাসিন্দা সুদর্শন রায়। তাঁর কথায়, “পুরনো দলিল-দস্তাবেজ থেকে জানা যায়, নানা রকমের মন্দির আর রাজবাড়ি দেখতে বহু আগেও দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ এই জনপদে আসতেন। আজ মন্দিরগুলোর হাল দেখলে দুঃখ হয়।” এক সময়, চন্দ্রকোনায় শীতকালে পর্যটনের মরসুমে প্রতি মাসে কয়েক হাজার পর্যটক ভিড় জমাতেন। এখন সেই সংখ্যাটা একশোও ছাড়ায় না।
শহরের জরাজীর্ণ ছোট অস্থল মন্দির। —নিজস্ব চিত্র।
চন্দ্রকোনা আগে ‘বাণিজ্য শহর’ বলেও পরিচিত ছিল। এখানে মটকি ঘি, কাঁসা, পিতল, তাঁতের নানা বস্ত্র, তামার নানা সামগ্রী তৈরি হত। প্রথমে রাজশাসনে, পরে ইংরেজ আমলে বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ার সুবাদে বহু মানুষের যাতায়াত ছিল চন্দ্রকোনায়। সেই থেকেই ‘বাহান্ন বাজার তিপান্ন গলির’ প্রবাদ চালু হয়েছিল বলে অনুমান। এখনও চন্দ্রকোনায় ছোট ছোট বাজার, সরু-সরু গলি ঘুঁজির অস্তিত্ব রয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণ আর সচেতনতার অভাবে সেই সব নিদর্শন আজ অবলুপ্তির পথে। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো চন্দ্রকোনা রাজবাড়ি ধ্বংসের পথে। কথিত আছে, কেতু বংশের আমলেই এই রাজবাড়ি তৈরি হয়। মূল রাজবাড়ির অস্তিত্ব প্রায় অবলুপ্ত। অযোধ্যাতে রাজাদের ঠাকুরবাড়িও ধ্বংসের পথে। জনশ্রুতি, ওই ঠাকুরবাড়িতে একসময় বর্ধমানের রাজারা থাকতেন। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, সেখানে সমাজ বিরোধীদের আস্তানা। বছর ষাটেক আগেও চন্দ্রকোনার বেশির ভাগ মন্দির ভালই ছিল। কিন্তু পুরসভা কিংবা প্রশাসনের উদ্যোগের অভাবে তা ভগ্নপ্রায়। বহু মন্দিরের টেরাকোটার কাজ উঠে গিয়েছে। মন্দিরগাত্রে উৎকীর্ণ লিপির অবস্থাও তাই। পুরভোটে রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্থাপত্য সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণে উদ্যোগী হবে। কিন্তু, বদলায়নি চিত্রটা। কেন? চন্দ্রকোনায় তৃণমূলের পুরপ্রধান রাম কামিল্যার যুক্তি, “বহুবার রাজ্য হেরিটেজ কমিশনকে জানিয়েছি। কিন্তু সাড়া পাইনি।” তাঁর আশ্বাস, “এ বার ক্ষমতায় এলে পুরনো স্থাপত্যের সংস্কারই প্রথম কাজ হবে।” পাঁচ বছরেও যা করতে পারেননি, পরের বার কী করে করবেন? সদুত্তর মেলেনি পুরপ্রধানের কাছ থেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাউন্সিলরের কথায়, আসলে বহু জনপ্রতিনিধির স্থানীয় ঐতিহ্য সম্পর্কেই অবহিতই নন! তিনি স্পষ্টই বলছেন, “চন্দ্রকোনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব নিয়ে শহরের গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া, আর কারোরই কৌতুহল নেই। ফলে রাজবাড়ি, মন্দির-সহ স্থাপত্যের ইতিহাস মাটিতে মিশতে শুরু করলেও কারোরই কিছু যায় আসে না!” অথচ, তা বাস্তবায়িত হলে এলাকার অর্থনীতি উপকৃত হয়, বলছেন তিনি।
চন্দ্রকোনার দ্রষ্টব্য জায়গাগুলিতে মাথা তোলেনি হোটেল-রিসর্ট। নেই পর্যাপ্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা ও শৌচাগারও। দু’দিন কাটানোর মতো নিরিবিলি, নিঝুম প্রাকৃতিক পরিবেশ বেশ উপভোগ্য। চন্দ্রকোনা ২ ব্লকের বিডিও গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য মানছেন সে কথা। তিনি বলেন, “চন্দ্রকোনার প্রাকৃতিক সৌর্ন্দয সত্যিই অনবদ্য। লালসাগর, ধামকুড়া প্রভৃতি এলাকাকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পের বিকাশে উদ্যোগী হব। ধলবাঁধে পিকনিক স্পট তৈরির কাজও অনেকটাই এগিয়েছে।”
এখন দেখার, ইতিহাস যে শহরকে বিখ্যাত করেছে, সেই শহর ইতিহাসকে বাঁচাতে কতটা উদ্যোগী হয়।