বন্ধ সাহায্য, অনাদরে হারাচ্ছে দুষ্প্রাপ্য প্রত্নবস্তু

বন্ধ হয়ে গিয়েছে সরকারি আর্থিক সাহায্য। চরম অর্থাভাবে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে কাঁথি মহকুমার একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র ‘রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দির ও সংগ্রহশালা’।

Advertisement

সুব্রত গুহ

রামনগর শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৪ ০১:১২
Share:

নষ্ট হতে বসেছে প্রাচীন সামগ্রী। ছবি: সোহম গুহ।

বন্ধ হয়ে গিয়েছে সরকারি আর্থিক সাহায্য। চরম অর্থাভাবে অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে কাঁথি মহকুমার একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র ‘রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দির ও সংগ্রহশালা’।

Advertisement

অর্থের অভাবে অর্ধেক হয়ে পড়ে রয়েছে সংগ্রহশালার নতুন ভবন নির্মাণের কাজ। ফলে অবহেলা ও অনাদরে পড়ে নষ্ট হচ্ছে রামনগর ২ ব্লকের কাদুয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ধাড়াস গ্রামের এই সংগ্রহশালাটির ইতিহাস, ভূতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্বের বহু মূল্যবান নিদর্শন। সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হতে বসেছে সংগ্রহশালায় থাকা দু’হাজার বছরের প্রাচীন রোমান অ্যামফোরা, অধুনা লুপ্ত প্লিস্টোসিন যুগের অতিকায় বন্য মহিষের মাথার জীবাশ্ম, প্রাচীন যক্ষিণী মূর্তি, দশম শতকের মহাবীর মূর্তি, ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিষ্ণু মূর্তি। এছাড়াও এই সংগ্রহশালায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ জীবাশ্ম, নানা ধরনের শিলা, উল্কাপিণ্ড, অতি প্রাচীন দলিল দস্তাবেজ, কুষাণ যুগ ও মধ্য যুগের বিভিন্ন আমলের কয়েকশো মুদ্রা থেকে শুরু করে লোকশিল্পের নানা মূল্যবান সম্ভার। বলা বাহুল্য, অবহেলায় সেগুলিও নষ্ট হওয়ার পথে।

সংগ্রহশালার সম্পাদক ও কিউরেটার অরবিন্দ মাইতির দাবি, “সংগ্রহশালার সবচেয়ে চমকপ্রদ বস্তুটি হল ৬০ ইঞ্চি লম্বা ও ৫৮ ইঞ্চি চওড়া ২টি রোমান অ্যামফোরা (হাতল দেওয়া ফুলদানি)। যেটি প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। এই দুটি অ্যামফোরার একটি রামনগরের করঞ্জি হাইস্কুলের কাছে পুকুর খননের সময় পাওয়া গিয়েছে। আর অন্যটি এক শিক্ষকের কাছ থেকে পাওয়া।” তবে অরবিন্দবাবুর আক্ষেপ, “অর্থাভাবে সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের কাজ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।”

Advertisement

রজনীকান্ত জ্ঞান মন্দির ও সংগ্রহশালাটি পরিদর্শন করে গিয়েছেন রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের উপ অধিকর্তা অমল রায়। অমলবাবুর কথায়, “রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকার এই সংগ্রহশালায় অনেক প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ রয়েছে। তবে সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী অ্যামফোরাটি প্রকৃতই রোমান যুগের কিনা, সে সম্পর্কে তেমন উপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।” অরবিন্দবাবু বলেন, “আমরাও চাই, রাজ্যের পুরাতত্ত্ব বিভাগ আমাদের সংগ্রহে থাকা অ্যামফোরাটি পরীক্ষা করে তাদের বক্তব্য জানাক।”

স্বাধীনতা সংগ্রামী ও স্থানীয় মানিকাবসান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রয়াত রজনীকান্ত মাইতির ইচ্ছা ছিল কাঁথি মহকুমা-সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া প্রাচীন নিদশর্নগুলি সযত্নে সংরক্ষণ করার। তাঁর জীবদ্দশায় সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। ১৯৭৫ সালে রজনীকান্তবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর কয়েকজন ছাত্র ও শুভানুধ্যায়ীর প্রচেষ্টায় ধাড়াস গ্রামে রজনীকান্তবাবুর বাড়িতেই গড়ে উঠে এই সংগ্রহশালা। সংগ্রশালার সূচনালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন রজনীকান্তবাবুর পুত্র অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক অরবিন্দ মাইতি। সংগ্রহশালাটি পরিচালনার জন্য ১১ জন সদস্যের একটি কমিটিও রয়েছে। প্রতি বছর রজনীকান্তবাবুর জন্মদিন ৫ অক্টোবর সংগ্রহশালায় নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সারা বছর এই সংগ্রহশালায় ভালই ভিড় হয়। রবিবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত সংগ্রহশালা খোলা থাকে।

অরবিন্দবাবু জানান, আগে সংগ্রহশালাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার থেকে বছরে ১০ হাজার টাকা অনুদান পাওয়া যেত। রামনগরের প্রাক্তন বিধায়ক স্বদেশ নায়ক ও গ্রামবাসীদের অর্থ সাহায্যে কয়েকবছর আগে সংগ্রহশালার আলাদা ঘর তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। তবে অর্থাভাবে সেই ঘর নির্মাণের কাজও অসম্পূর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে। অন্য দিকে, গত দু’বছরের বেশি সময় ধরে সরকারি অনুদানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁর কথায়, “অনেক ছোটাছুটি করেও সরকারি অনুদান বন্ধ হওয়ার কারণ জানতে পারিনি।” সংগ্রহশালার জন্য অরবিন্দবাবু ১০ ডেসিমেল জমি দান করেছেন। তবে অর্থ সঙ্কটে সংগ্রহশালার হাল ফেরানো যায়নি। কাঁথির মহকুমাশাসক পদাধিকার বলে সংগ্রহশালার সভাপতি। মহকুমাশাসক সরিৎ ভট্টাচার্য বলেন, “আমি বেশিদিন এখানে আসিনি। এ বিষয়ে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখব।”

রামনগরের তৃণমূল বিধায়ক অখিল গিরি বলেন, “রজনীকান্ত জ্ঞানমন্দির সমগ্র মেদিনীপুর জেলার গর্ব। ওই সংগ্রহশালার সরকারি বার্ষিক অনুদান কি কারণে বন্ধ হল, সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব। সংগ্রহশালার উন্নতিকল্পে বিধায়ক এলাকা উন্নয়ন তহবিল থেকেও ভবিষ্যতে অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করব।” যদিও রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের উপ অধিকর্তা অমলবাবু জানিয়েছেন, চলতি বছরেই রাজ্য সরকার একটি কমিটি গঠন করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর কমিটির কাছে রাজ্যের বিভিন্ন পুরাতাত্ত্বিক সংগ্রহশালাগুলিকে অনুদান পাওয়ার জন্য আবেদন করতে হবে। আবেদনের ভিত্তিতে কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে বিভিন্ন সংস্থাকে অনুদান দেওয়া হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন