দ্রুত গতিতে চলছে কংসাবতীর অ্যানিকেত বাঁধের কাজ। —নিজস্ব চিত্র।
গেল বছরের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন হয়েছিল একের পর এক গ্রাম। আগাম তেমন কোনও সতর্কতাও ছিল না।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার তাই ভারী বর্ষার আগেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বাঁধ মেরামতিতে তৎপর হয়েছে সেচ দফতর। কোথাও কোনও বাঁধে ক্ষত রয়ে গিয়েছে কি না, পরিদর্শনে গিয়ে দেখছেন সেচ-কর্তারা। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে জেলা পরিষদে এক বৈঠকও হয়েছে। সেচ স্থায়ী সমিতির যে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, কোথাও সামান্য ক্ষত দেখা গেলেও তড়িঘড়ি তা মেরামত করতে হবে। মেরামতের কাজ শেষ করতে হবে ভারী বর্ষা আসার আগেই। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি নদীবাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। ডেবরার ৬টি বাঁধ, ঘাটালের ৬টি বাঁধ সংস্কার হচ্ছে। গোপীবল্লবপুরের চর্চিতার বাঁধ সংস্কার হচ্ছে। তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে রয়েছে এই বাঁধ। জেলা পরিষদের সেচ কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ বলেন, “বর্ষার আগেই আমরা বাঁধ মেরামতের উপর জোর দিয়েছি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি বাঁধ সংস্কারের কাজ চলছে। বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন শুরু হয়েছে। কোথাও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানতে পারলেই আমরা দ্রুত পদক্ষেপ করব।”
এলাকার বাঁধগুলোর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে চলতি সপ্তাহ থেকে কয়েকটি ব্লকে বৈঠক শুরু হয়ে গিয়েছে। জেলার সেচ দফতরের এক কর্তার কথায়, “এটা ঠিক, আগাম না জানিয়ে জলাধার থেকে প্রচুর পরিমাণ জল ছাড়া হলে পরিস্থিতি কখনও-সখনও আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। জলের তোড়ে বাঁধ ভাঙে। তখন গ্রামে হু হু করে নদীর জল ঢুকে পড়ে। নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইলে অনেক সময়ই করার কিছু থাকে না। আগাম জানা থাকলে তখন পদক্ষেপ করা সম্ভব হয়।”
গত বছর জুনের গোড়ায় ভেসে গিয়েছিল ডেবরার টাবাগেড়িয়া। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে বাড়ির দালানে বিশ্রাম করছিলেন পিন্টু মাহালি। হঠাৎ দেখেন, জলের স্রোত ঢুকছে বাড়ির ভিতরে। বাড়িতে তখন বাবা-মা’র সঙ্গে স্ত্রী কুসুমদেবী এবং দেড় বছরের কন্যা প্রতিমা। কী করবেন, শুরুতে ভেবেই পাচ্ছিলেন না। প্রতিবেশীদের দেখে শেষমেশ হাঁটুজল ঠেলে বাড়ি থেকে বেরোন। সপরিবার ঠাঁই নেন স্থানীয় ত্রাণ শিবিরে। পিন্টুবাবু মুম্বইয়ে সোনার কাজ করেন। বন্যার ক’দিন আগেই বাড়িতে এসেছিলেন। নেহাত দুপুরবেলায় নদীর জল বেড়েছিল। রাতের বেলায় বাঁধ ভাঙলে যে কী পরিস্থিতি হত, তা ভাবতে গিয়ে এখনও শিউরে ওঠেন টাবাগেড়িয়া, মোকারিমপুর, গোপালপুর, রাইপুরের বাসিন্দারা। পরে বন্যা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে জেলায় আসেন সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ও।
পশ্চিম মেদিনীপুরে ফি বছরই বন্যা হয়। অধিকাংশ সময় বাঁধ ভাঙার ফলেই দুর্ভোগ বাড়ে। গেল বছর যেমন বাঁধ ভেঙে দাসপুর, ডেবরা, কেশপুর, সবং, গোপীবল্লভপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়েছিল। বানভাসি হন প্রচুর মানুষ। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তড়িঘড়ি জেলা জুড়ে ১০৪টি ত্রাণ শিবির খুলতে হয়। সেচমন্ত্রীর পাশাপাশি জেলায় ছুটে আসেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ে বৈঠক করে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। বন্যা-কবলিত এলাকায় গিয়ে ত্রাণও বিলি করেন।
কেন ফি বছর বন্যা হয় পশ্চিম মেদিনীপুরে? জেলায় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ ১,৫৪২ মিলিমিটার। কিন্তু, এই পরিমাণ বৃষ্টিতে তো প্রচুর সংখ্যক মানুষের বানভাসি হওয়ার কথা নয়। আসলে টানা বৃষ্টি হলে জলাধার থেকে জল ছাড়া হয়। জলাধারের ছাড়া জল নদীতে এসে মিশলে নদী ফুলেফেঁপে ওঠে। নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বইলে দুর্বল বাঁধগুলো সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন বাঁধ ভেঙেই একের পর এলাকায় জল ঢুকতে শুরু করে। একাংশ গ্রামবাসীর দাবি, বাঁধগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হলে আচমকা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় না। কিন্তু, বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে সেচ দফতরের তেমন উদ্যোগ থাকে না। গেল বছরও বন্যার পর বিভিন্ন এলাকায় এমন ক্ষোভ সামনে আসে। বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পরও সেচ দফতরের কর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। জলের তোড়ে যখন একের পর এক গ্রাম জলের তলায় চলে যাচ্ছে, তখন কী ভাবে বাঁধ ভাঙা হবে তা বলার মতো লোকও ছিল না। সেচ-কর্তাদের অবশ্য যুক্তি, আগাম সতর্কবার্তা না থাকার ফলেই কিছু এলাকায় এমন সমস্যা দেখা দিয়েছিল। গত বছর জেলায় ২ হাজার মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। চলতি মাসেই বর্ষা শুরু হওয়ার কথা। সেচ কর্মাধ্যক্ষ বলেন, “বন্যা সংক্রান্ত আগাম সতর্কতা নিয়ে ইতিমধ্যে আমরা বৈঠক করেছি। পঞ্চায়েত সমিতিগুলোকে কিছু নির্দেশও দিয়েছি।”