রেললাইনে ঝাঁপ, মৃত প্রাক্তন পুরপ্রধান নাজিম

কখনও বুলডোজারের মাথায় চড়ে বেআইনি নির্মাণ ভেঙেছেন। কখনও পুরসভার ভল্টে টাকা থাকায় সারা রাত পুরভবনের সামনে লাঠি হাতে পাহারা দিয়েছেন। বিবেকানন্দের মূর্তি দেখিয়ে ‘ওই যাঁর মাথায় পাগড়ি আছে’ বলায় এক পুর-কর্মীকে সাসপেন্ড পর্যন্ত করেছেন। আর বড়দিনে সান্তা সেজে পৌঁছে গিয়েছেন গ্রামে-গঞ্জে। মেদিনীপুরের মানুষ এমনই নানা ভূমিকায় দেখেছে প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা বর্তমান কাউন্সিলর নাজিম আহমেদ (৬৭)-কে। বর্ণময় সেই মানুষটিই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেলেন শুক্রবার।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৫
Share:

কখনও বুলডোজারের মাথায় চড়ে বেআইনি নির্মাণ ভেঙেছেন। কখনও পুরসভার ভল্টে টাকা থাকায় সারা রাত পুরভবনের সামনে লাঠি হাতে পাহারা দিয়েছেন। বিবেকানন্দের মূর্তি দেখিয়ে ‘ওই যাঁর মাথায় পাগড়ি আছে’ বলায় এক পুর-কর্মীকে সাসপেন্ড পর্যন্ত করেছেন। আর বড়দিনে সান্তা সেজে পৌঁছে গিয়েছেন গ্রামে-গঞ্জে।

Advertisement

মেদিনীপুরের মানুষ এমনই নানা ভূমিকায় দেখেছে প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা বর্তমান কাউন্সিলর নাজিম আহমেদ (৬৭)-কে। বর্ণময় সেই মানুষটিই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেলেন শুক্রবার। সাতসকালে মালগাড়ির নীচে দু’খণ্ড হয়ে গিয়েছে তাঁর দেহ। প্রাথমিক তদন্তে রেল পুলিশের অনুমান, এটি আত্মহত্যা।

রেল সূত্রের খবর, এ দিন সকাল সাড়ে ৬টায় আদ্রাগামী মালগাড়িটি ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার পরে ঘটনাটি ঘটে। স্থানীয় সূত্রের খবর, প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় উড়ালপুলের নীচে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাজিম। মালগাড়িটি স্টেশন ছাড়তেই রেললাইনে গিয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। তাঁর উপর দিয়ে চলে যায় মালগাড়ির চাকা। খবরটা ছড়াতে দেরি হয়নি। দেহ তুলে মেদিনীপুর মেডিক্যালে পাঠানোর আগেই কাতারে কাতারে মানুষ আসেন স্টেশনে। মর্গে ও বাড়িতেও ছিল উপচে পড়া ভিড়। দল-মত-রাজনীতির উর্ধ্বে আদ্যন্ত আবেগপ্রবণ প্রিয়জনকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী ও অগুনতি সাধারণ মানুষ। মেদিনীপুরের বর্তমান পুরপ্রধান তৃণমূলের প্রণব বসু বলেন, “ওঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বর্ণময়। ভাল প্রশাসক ছিলেন। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতেন।”

Advertisement

কিন্তু দৃঢ়চেতা, স্পষ্টবক্তা মানুষটি কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন, তা বোধগম্য হচ্ছে না অনেকেরই। ভেঙে পড়েছেন স্ত্রী রহিমা বেগম। শুধু বলছেন, “কিছু দিন ধরেই শরীর খারাপ ছিল। মন মেজাজও ভাল ছিল না। কিন্তু এ ভাবে সব ওলটপালট হয়ে যাবে ভাবিনি।” কংগ্রেস নেতা তথা দীর্ঘদিনের কাউন্সিলর সৌমেন খানের কথায়, “ক’দিন ধরেই বলছিলেন, “আর বাঁচব না। কিছু হয়ে গেলে বৌদিকে দেখো। কিন্তু আত্মহত্যা করবেন ভাবতে পারিনি।”

পরিচিতজনেরা জানিয়েছেন, কিছু দিন ধরেই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন নাজিম। পেশায় তিনি ছিলেন ম্যারেজ রেজিস্ট্রার। সেখানে কোনও ভুলচুকের জেরে পুলিশ তাঁকে ভবানীভবনে ডেকে নিয়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও ছিল তাঁর। আর ছিল অসুখ-ভীতি। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন সিপিএমের মেদিনীপুর জোনাল সম্পাদক কীর্তি দে বক্সী। তিনি বলেন, “বিভিন্ন চিকিৎসককে দেখানোর পর জানা যায় উনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।” সেই মতো চিকিৎসাও শুরু হয়। তার পরেও বেশ কয়েক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন নাজিম। বৃহস্পতিবারও রাত ৯টা নাগাদ তিনি মেদিনীপুর স্টেশনে গিয়েছিলেন।

জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন বলেই বোধহয়, দীর্ঘ ২০ বছর যে মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি (ভালবেসে বিয়ে করায়), এক সপ্তাহ আগে তাঁদের বুকে টেনে নেন। মেয়ে তুহিনাকে আর শ্বশুরবাড়িতে যেতেও দেননি। নাজিমের জামাই শেখ সফিক বলেন, “তুহিনা এই ক’দিন বড় জোর এক ঘন্টা বাড়িতে আসত। বেশির ভাগ সময় বাবার কাছেই থাকত।” নজরে নজরে রেখেও শেষরক্ষা হল না। এ দিন মোটরবাইক নিয়েই বেরোন নাজিম। মেদিনীপুর স্টেশনের সামনে মোটরবাইকটি রেখে দোকানে চা-ও খান। তার পর হাঁটা দেন স্টেশনের দিকে।

নাজিম ছাত্রজীবনে নকশাল আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন। পরে কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি ছিলেন কাউন্সিলর। বরাবর জিতেছেন ১১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে। তিন দফায় পুরপ্রধানও হন। ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের বোর্ডের পুরপ্রধান ছিলেন। ২০০২ সালের জুলাই থেকে ২০০৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্তও ছিলেন কংগ্রেস পুরপ্রধান। পরে ‘বিকাশ পরিষদ’ গড়েন এবং বামফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০০৮ সালের জুলাই পর্যন্ত পুরপ্রধানের দায়িত্ব সামলান।

২০০৪ সালে পাঁশকুড়া কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে লোকসভা ভোটে লড়ে হেরে যান। আর পুরভোটে হেরেছিলেন ২০০৮ সালে। সে বার ১১ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় অন্য ওয়ার্ডে দাঁড়িয়েছিলেন নাজিম। ১১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে অবশ্য জেতেন নাজিমের স্ত্রী। পুরপ্রধান থাকাকালীন কখনও ছুটে গিয়েছেন বাংলাদেশ, আবার কখনও পাকিস্তানে। সেখানে পুরসভা কী ভাবে চলে দেখে এসেছেন। পাকিস্তানে বিজেপি নেতা এল কে আডবাণীর পৈতৃক ভিটেতে গিয়েছিলেন। পরে দিল্লিতে এসে আডবাণীর সঙ্গে দেখাও করেছেন।

এ দিন সন্ধ্যায় তাঁতিগেড়িয়ায় সমাহিত করা হয় নাজিম আহমেদকে। শোকযাত্রায় সব দলের নেতা-কর্মীরাই ছিলেন। সমাধিস্থলে হাজির ছিলেন তৃণমূলের উপপুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস। আর ছিল অগুনতি শহরবাসী। চোখের জলেই মেদিনীপুরবাসী তাঁদের প্রিয় মানুষটিকে বিদায় জানান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন