লক্ষ্মীপুজোতেই শারদোত্‌সব হাড়দায়

দেবীর পুজো হয় শাস্ত্রীয় মতে। কিন্তু দেবীর মূর্তিতে রয়েছে লৌকিক আদল। এক চালচিত্রে লক্ষ্মী-সরস্বতী রূপা দেবীর মাথার উপর থাকেন পীতবসন ধারী চৈতন্যস্বরূপ নারায়ণ। তাই কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে শাঁখ বাজিয়ে ও হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে শুরু হয় বিনপুরের হাড়দা গ্রামের ‘মোড়ল’ পরিবারের শতাব্দী-প্রাচীন লক্ষ্মীপুজো।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৯
Share:

হাড়দার লক্ষ্মী প্রতিমা। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

দেবীর পুজো হয় শাস্ত্রীয় মতে। কিন্তু দেবীর মূর্তিতে রয়েছে লৌকিক আদল। এক চালচিত্রে লক্ষ্মী-সরস্বতী রূপা দেবীর মাথার উপর থাকেন পীতবসন ধারী চৈতন্যস্বরূপ নারায়ণ। তাই কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে শাঁখ বাজিয়ে ও হরিনাম সংকীর্তনের মাধ্যমে শুরু হয় বিনপুরের হাড়দা গ্রামের ‘মোড়ল’ পরিবারের শতাব্দী-প্রাচীন লক্ষ্মীপুজো। গ্রামের আড়াইশোটি পরিবারের এই পুজোর জাঁক দুর্গাপুজোর চেয়েও অনেক বেশি। বাজেট প্রায় দশ লক্ষ টাকা!

Advertisement

জনশ্রুতি, বহু বছর আগে হাড়দার শুঁড়ি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা গ্রামের সম্পন্ন ‘মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাই ওই পরিবার গুলিকে ‘মণ্ডল-বাকুল’ বলা হতো। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে গ্রামের অক্রুর মোড়ল স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে মণ্ডল-বাকুলের পারিবারিক কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো শুরু করেন। দেড়শো বছর আগে মণ্ডল-বাকুলের অধীনে ৬০টি পরিবার ছিল। এখন গ্রামের মণ্ডল-বাকুলের পরিবার সংখ্যা আড়াইশো ছাড়িয়েছে। তবে সবার পদবি মণ্ডল নয়। সাহা, বিশুই, আদিত্য ইত্যাদি নানা পদবি রয়েছে পরিবারের সদস্যদের। হাড়দা গ্রামটি বেশ বড়। মণ্ডল-বাকুলের আড়াইশোটি পরিবার ছাড়াও গ্রামে আরও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাস। তবে, পুজোর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করে কেবলমাত্র মণ্ডল-বাকুল ভুক্ত আড়াইশোটি পরিবার। আগে খড়ের ছাউনির মাটির ঘরে পুজো হতো। বছর তিনেক হল স্থায়ী পাকা লক্ষ্মী মন্দির তৈরি করা হয়েছে। প্রতি বছর একই কাঠামোর উপর মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি করা হয়। লক্ষ্মীর বাঁদিকে থাকেন সরস্বতী। চালচিত্রে দুই দেবীর দু’পাশে দু’জন করে মোট চারজন সখি থাকেন। তাঁদের বলা হয় ‘লুক-লুকানি’।

পুজো কমিটির সম্পাদক সিন্টু সাহা বলেন, “কেন দেবীর এমন রূপ তা আমাদের অজানা। তবে, বিষ্ণু পুরাণ মতে, নারায়ণের দুই স্ত্রী হলেন লক্ষ্মী ও সরস্বতী। সম্ভবত, সেই কারণে নারায়ণের সঙ্গে তাঁর দুই স্ত্রীর পুজো করা হয়।” তবে ঝাড়গ্রামের বিশিষ্ট লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “হাড়দায় মণ্ডলদের পারিবারিক পুজোয় চৈতন্যস্বরূপ নারায়ণের সঙ্গে সম্পদ ও জ্ঞান রূপা দুই দেবীর সহাবস্থানের বিষয়টি একেবারেই লৌকিক ভাবনা প্রসূত।”

Advertisement

কোজাগরীর সন্ধ্যায় সমবেত শঙ্খধ্বনি ও হরিনাম সংকীর্তন সহযোগে শোভাযাত্রা করে গ্রামের মণ্ডল দিঘিতে ঘটের জল ভরতে যাওয়া হয়। ওই সময় টানা কয়েক ঘন্টা ধরে আতসবাজি পোড়ানো হয়। বংশানুক্রমিক পূজারী ব্রাহ্মণ শাস্ত্রীয় মতে পুজো করেন। দেবীকে মূলত ছোলার বেসন থেকে তৈরি বুটের নাড়ুর ভোগ দেওয়া হয়। প্রথমে ঘিয়ে ভেজে নেওয়া হয় বেসনের ঝুরি। তারপর ঘন চিনির রসে সেই ঝুরি মিশিয়ে তৈরি হয় গোলাকার নাড়ুগুলি। দেবীর অন্নভোগ হয় না। তবে লুচি ও সুজি নিবেদন করা হয়। প্রতিপদের ভোরে পুজো শেষ হয়। হাড়দার লক্ষ্মীপুজোর মেলায় কেবলমাত্র প্রতিপদের দিনে চালগুঁড়ি ও বিউলি ডাল গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা হয় এক ধরনের অনন্য স্বাদের জিলিপি। দূরদূরান্তের মানুষ এই জিলিপি কিনতে আসেন।

পুজো কমিটির সম্পাদক সিন্টু সাহা জানালেন, মণ্ডল-পরিবারের যে সব সদস্যরা গ্রামের বাইরে থাকেন, তাঁরাও লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে গ্রামে আসেন। এবার ১৫৩ তম বর্ষের পুজোর বাজেট দশ লক্ষ টাকা। পুজো উপলক্ষে টানা পাঁচদিন ধরে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।” গ্রামের বধূ তথা হাড়দা গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য পুতুল সাহার বক্তব্য, “গ্রামের পারিবারিক এই লক্ষ্মীপুজোটিকে ঘিরে আমরা শারদোত্‌সবের আনন্দে মেতে উঠি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন