শুকনো খেত, তবু জারি সরকারি উৎসব

ধামসা-মাদলের তালে দুলে দুলে উঠছে বেলপাহাড়ি ব্লক অফিসের লাগোয়া ময়দান। বুধবার সে উত্‌সবে সামিল শাসকদলের মন্ত্রী থেকে জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় লোকসংস্কৃতি তুলে ধরছেন তাঁরা উৎসব মঞ্চ থেকে। পাশাপাশি গলার শিরা ফুলিয়ে রাজ্য সরকারের উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন শাসক-প্রশাসনের কেষ্টবিষ্টুরা।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০১:২০
Share:

বেলপাহাড়ি ব্লক অফিস লাগোয়া ময়দানে ব্লক জঙ্গলমহল উত্‌সবে আদিবাসী লোকসংস্কৃতির নাচগান (বঁা দিকে), জলের অভাবে মাঠে নষ্ট হয়ে গিয়েছে আমন ধান। বেলপাহাড়ির ডাইনমারিতে (ডান দিকে)। দেবরাজ ঘোষের তোলা ছবি।

ধামসা-মাদলের তালে দুলে দুলে উঠছে বেলপাহাড়ি ব্লক অফিসের লাগোয়া ময়দান। বুধবার সে উত্‌সবে সামিল শাসকদলের মন্ত্রী থেকে জনপ্রতিনিধি। স্থানীয় লোকসংস্কৃতি তুলে ধরছেন তাঁরা উৎসব মঞ্চ থেকে। পাশাপাশি গলার শিরা ফুলিয়ে রাজ্য সরকারের উন্নয়নের বার্তা দিচ্ছেন শাসক-প্রশাসনের কেষ্টবিষ্টুরা। তবু সে কোলাহলে চাপা থাকল না বেলডাঙার বিশ্বনাথ মাহাতো, পচাপানির রসময় কালিন্দি, শিমুলপালের অমূল্য মাহাতোদের মতো কয়েকশো চাষির দীর্ঘশ্বাস।

Advertisement

পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে মাঠে শুকিয়ে গিয়েছে সিংহভাগ আমন ধান। চাষির ঘরে দুশ্চিন্তায় কালোছায়া। সামান্য যেটুকু চাষ হয়েছে সেই ধানটাও অভাবী বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন চাষিরা। এখনও সরকারি ভাবে ধান কেনা শুরু হয়নি। শুধু বেলপাহাড়ি নয়, গোটা জঙ্গলমহল জুড়ে একই ছবি। মাঠের পর মাঠ জুড়ে জলের অভাবে শুকিয়ে গিয়েছে আমন ধান। ফসল কাটার মরশুমে ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের ঘরে-ঘরে শোকের আবহ।

একই সঙ্গে জঙ্গলমহল উত্‌সবের আনন্দ আর সর্বহারা চাষির দীর্ঘশ্বাসের বিপরীত ছবি। সরকারের উন্নয়ন বার্তা তুলে ধরার জন্য ২১ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্লকে ব্লকে জঙ্গলমহল উত্‌সব হচ্ছে। কোনও ব্লকে এক দিনের উত্‌সব। কোথাও আবার দু’দিনের আনন্দযজ্ঞ। রাজ্য সরকারের এমন ভূমিকায় সমালোচনার ঝড় উঠেছে স্থানীয় মহলে। জঙ্গলমহলকে খরা কবলিত এলাকা ঘোষণা করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

Advertisement

ইতিমধ্যেই প্রশাসনিক মহলে স্মারকলিপি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে একাধিক গণ-সংগঠন। বিরোধীদের অভিযোগ, সর্বস্বান্ত চাষিদের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন দফতরের সরকারি টাকায় ব্লকে ব্লকে ‘মোচ্ছব’ হচ্ছে। বিপন্ন মানুষের পাশে না-দাঁড়িয়ে এ ধরনের উত্‌সবকে নির্মম রসিকতা বলে কটাক্ষ করছেন তাঁরা।

উৎসবে যোগ দিতে পারেননি জঙ্গলমহলের চাষিরা। বেলপাহাড়ির ছোট চাষি রসময়বাবু, অমূল্যবাবুদের বক্তব্য, “জঙ্গলমহলের বেশির ভাগ জমিতে সেচের ব্যবস্থা নেই। ফলে আকাশই ভরসা। কিন্তু এবার চাষের উপযোগী বৃষ্টিই তো হয়নি। কৃষিঋণ কী ভাবে মেটাব তা ভেবেই পাচ্ছি না। আনন্দ-উত্‌সব যাওয়ার মানসিকতা নেই।”

বুধবার বেলপাহাড়ি ব্লকের জঙ্গলমহল উত্‌সবের উদ্বোধন করেন পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। জঙ্গলমহলে সর্বস্বান্ত চাষিদের পাশে না দাঁড়িয়ে এমন উত্‌সবের আয়োজন কতটা যুক্তিসঙ্গত? বিরোধীদের এই প্রশ্ন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে মন্ত্রী শান্তিরামবাবুর জবাব, “জঙ্গলমহলের গ্রামে গ্রামে যে সব লোকশিল্পী রয়েছেন, তাঁদের মর্যাদা দেওয়ার বিষয়টিও আমাদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। বেলপাহাড়ি ব্লকের ৯ হাজার মানুষ এ দিন উত্‌সবে যোগ দিয়েছিলেন।” তবে মন্ত্রী মানছেন, বৃষ্টির ঘাটতির জন্য বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের কোনও কোনও এলাকায় চাষের ক্ষতি হয়েছে। তাঁর দাবি, “এ বিষয়ে ক্যাবিনেটে আলোচনা হয়েছে। রাজ্য সরকার বিষয়টি নিয়ে ভাবছে।”

মঙ্গলবারই ঝাড়গ্রাম মহকুমাকে খরা কবলিত এলাকা ঘোষণা-সহ ৭ দফা দাবিতে ঝাড়গ্রামের মহকুমাশাসককে স্মারকলিপি দিয়েছে ‘অল ইন্ডিয়া পিপলস্‌ ফোরাম’-এর পশ্চিম মেদিনীপুর শাখা। সংগঠনের নেতা শৈলেন মাইতি বলেন, “ধৃত মাওবাদী লিঙ্কম্যানদের চাকরি-প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে। অথচ প্রকৃত প্রান্তিক চাষিদের নিয়ে সরকারের কোনও মাথা ব্যথা নেই।”

সম্প্রতি ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রশাসনিক মহলে একই দাবিতে স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে। জঙ্গলমহল উত্‌সবকে কটাক্ষ করে এলাকায় পোস্টার দিয়েছে কংগ্রেস। পোস্টারে বলা হয়েছে, ‘খরায় জঙ্গলমহল নিরন্ন, হাসতে দেখছে নবান্ন’। ঝাড়গ্রাম জেলা কংগ্রেসের মুখ্য সংগঠক সুব্রত ভট্টাচার্য বলেন, “সরকার রাজধর্ম পালন করছে না। নাচনকোদন বন্ধ করে অবিলম্বে চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।” খরা সমস্যার স্থায়ী সমাধানেরও দাবি করেছে কংগ্রেস।

সিপিএমের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কৃষকসভার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক হরেকৃষ্ণ সামন্ত বলেন, “প্রথম দিকে বর্ষার বৃষ্টি হলেও পরে বেলপাহাড়ি-সহ জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় টানা দু’মাস বৃষ্টি হয়নি। ওই সব এলাকার সমস্ত ধান শুকিয়ে গিয়েছে। অথচ সরকারের কোনও হেলদোল নেই। এখন উত্‌সব চলছে। এটা অত্যন্ত বেদনার বিষয়।” জঙ্গলমহলকে খরা এলাকা ঘোষণা এবং ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের ক্ষতিপূরণের দাবিতে ব্লকে ব্লকে আন্দোলন কর্মসূচি করছেন হরেকৃষ্ণবাবুরা।

জঙ্গলমহলের বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টিনির্ভর চাষ হয়। সম্পন্ন চাষিরা অবশ্য অগভীর পাম্পের সাহায্যে জমিতে সেচের জল দেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে পাম্প চালিয়ে সেচ দেওয়ার মত ক্ষমতা ছোট ও প্রান্তিক চাষিদের নেই। ফলে, আমন চাষে আকাল দেখা দিয়েছে। জঙ্গলমহলের সর্বত্রই এই হাহাকারের ছবি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন