স্কুলছুটদের বাড়ি গিয়ে কথা বলছেন ভাদুতলা বিবেকানন্দ হাইস্কুলের শিক্ষকেরা। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
চড়া রোদ্দুর। বাড়ির দালানে বসেছিলেন নন্দ সিংহ। মোরাম রাস্তা ধরে মাস্টারমশাইদের আসতে দেখে কিছুটা ঘাবড়েই গিয়েছিলেন নন্দ। বিস্ময়ে বলেই ফেললেন, ‘আপনারা? এই দুপুরে!’ এক মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার ছেলে সুদীপ কোথায়? ওকে ডাকুন। বলুন, আমরা এসেছি।’
উত্তরে শিক্ষকরা শুনলেন, সুদীপ স্থানীয় এক পাতা সেলাইয়ের কারখানায় কাজ নিয়েছে। মাস্টারমশাইদের জোরাজুরিতে সেখান থেকে সুদীপের বাবা ডেকে আনলেন ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ওই ছাত্রকে। কেন স্কুলে যাচ্ছিস না? মাস্টারমশাইয়ের প্রশ্নে নিরুত্তর এই স্কুলছুট ছাত্র। পাশ থেকে নন্দবাবু বললেন, “আমার একটাই ছেলে। ওকে আরও পড়াতেও চাই। পড়লে তো নিজের ভবিষ্যতটাও ভাল হবে। কত বলি। তবু কথা শোনে না!”
নন্দবাবুর বাড়ি বালিজুড়িতে। নিজের সামান্য জমি রয়েছে। মজুরির কাজও করেন। রোজগারের জন্যই সুদীপ স্কুল ছেড়ে পাতা সেলাইয়ের কাজ খুঁজে নিয়েছে। মেশিনে শালপাতা সেলাই করে দিনে কত রোজগার হতে পারে? স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, ১২০-১৬০ টাকা। এক হাজার পাতা সেলাই করলে মেলে ৪০ টাকা। এক জন দিনে ৩-৪ হাজার পাতা সেলাই করে থালা বানাতে পারে।
অনেকেই কিশোর বয়সে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে রোজগারের পথ খুঁজে নিচ্ছে। জেলায় স্কুলছুট বাড়ার এটা অন্যতম একটা কারণ। পরিস্থিতি দেখে স্কুলছুট পড়ুয়াদের স্কুলে ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছেন মাস্টারমশাইরা। তাঁরা স্কুলছুটদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন। শুক্রবার দুপুরেও ভাদুতলা বিবেকানন্দ উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ক’য়েকটি দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন গ্রামে যান। স্কুলছুট ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন।
শিক্ষকদের পরামর্শে এ দিন দুপুরেই স্কুলে আসে বালিজুড়ির সুদীপ। শিক্ষকদের সে কথা দেয়, “এ বার পড়াশোনাটা করব।” তাকে নবম শ্রেণিতে ফের ভর্তিও করে নেওয়া হয়। সহ-শিক্ষকদের দলে ছিলেন সুরজিৎ ঘোষাল, প্রতাপ পাঁজা। প্রতাপবাবু বলছিলেন, “নানা কারণে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলছুট হয়। কোনও কোনও মেয়ের কম বয়সে বিয়ে হয়। আবার কোনও পড়ুয়া কম বয়সে কাজের খোঁজ করে। কারও পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়।”
প্রধান শিক্ষক অমিতেশ চৌধুরীর কথায়, “আমরা জানি, সব স্কুলছুটকে ফেরানো সম্ভব নয়। তা-ও যত বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে স্কুলে ফেরানো যায়, সেই চেষ্টাই করছি।” বাড়ি বাড়ি যাওয়া কেন? তাঁর যুক্তি, “অভিভাবকরা সচেতন হলে স্কুলছুটের সংখ্যা কমবে। তাই আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছি। কেন পড়াশোনাটা জরুরি, তা বোঝাচ্ছি।”
সুফল কী মিলছে? স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, মিলছে। এ বছরের গোড়ায় দেখা যায়, স্কুলের ১,২১৩ জন পড়ুয়ার মধ্যে ৪১ জন স্কুলছুট হয়েছে। ইতিমধ্যে ৯ জনকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা সম্ভবও হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানান, আরও ১২ জনের ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাকি ২০ জনের ফেরার সম্ভাবনা কম।
২০১৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পশ্চিম মেদিনীপুরে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২ হাজার ৪৭৬। বছর দু’য়েক আগে ২০১১ সালে সংখ্যাটা ছিল ৭ হাজার ৫১১। দেখা যায়, ১২ হাজার ৪৭৬ জন স্কুলছুটের মধ্যে ৩ হাজার ৪০৩ জন প্রাথমিকস্তরের। অর্থাৎ, প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া। ৯ হাজার ৭৩ জন উচ্চ-প্রাথমিকস্তরের। অর্থাৎ, পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া।
স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে বয়সের একটা বিধি থাকে। সাধারণত, এর পর স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয় না। তবে, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন বা প্রতিবন্ধী পড়ুয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য এই বয়সে কিছু ছাড় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ১৮ বছর বয়সীদেরও উচ্চ-প্রাথমিকস্তরে ভর্তি নেওয়া যায়।
১২ হাজার ৪৭৬ জন স্কুলছুটের মধ্যে এখনও পর্যন্ত ঠিক কত জনকে স্কুলে ফেরানো সম্ভব হয়েছে? জানা গিয়েছে, সংখ্যাটা ৭ হাজারের আশপাশে। একাংশ স্কুলছুটের আবার স্কুলে ভর্তি হওয়ার বয়স পেরিয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের ২৮০ জন। উচ্চ-প্রাথমিকের ৩,৭০৭ জন। একাংশ ছাত্রছাত্রী আবার কাজের খোঁজে পরিবারের সঙ্গে অন্যত্র চলে গিয়েছে। এই সংখ্যাটা সব মিলিয়ে ১ হাজার ২ জন। প্রাথমিকের ১১৩ জন, উচ্চ-প্রাথমিকের ৮৮৯ জন।
মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক প্রসূনকুমার পড়িয়ার মতে, “আমরা অভিভাবকদের বলি, ছেলেমেয়েদের বোঝাতে হবে। পড়াশোনার দিকে নজর রাখতে হবে। তবেই পড়াশোনায় আগ্রহ তৈরি হবে।” জেলা পরিষদের শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ শ্যামপদ পাত্রের আশ্বাস, “অধিকাংশকেই স্কুলে ফেরানো সম্ভব হয়েছে। স্কুলছুটের সংখ্যা কমাতে আগামী দিনে সচেতনতা কর্মসূচিতে আমরা আরও জোর দেব।”