সিনেমা হল নেই, ছুটতে হয় সেই খড়্গপুর

মাস খানেক আগেও ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে লম্বা লাইন পড়ে যেত শহরের পূজা সিনেমা হলে। কিন্তু সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনার পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে হলটি বন্ধ। সিনেমা দেখতে শহরের বাসিন্দাদের ভরসা স্রেফ টেলিভিশন আর কেবল অপারেটর।

Advertisement

অভিজিত্‌ চক্রবর্তী

চন্দ্রকোনা শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:৪৮
Share:

তালা ঝুলছে শহরের পূজা সিনেমা হলে।—নিজস্ব চিত্র।

মাস খানেক আগেও ছুটির দিনে সিনেমা দেখতে লম্বা লাইন পড়ে যেত শহরের পূজা সিনেমা হলে। কিন্তু সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনার পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপে হলটি বন্ধ। সিনেমা দেখতে শহরের বাসিন্দাদের ভরসা স্রেফ টেলিভিশন আর কেবল অপারেটর।

Advertisement

আশির দশকে ছোটদের জন্য পুরসভার উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছিল একটি পার্ক। বিকেল হলেই সেখানে ভিড় জমাত খুদেরা। বয়স্করাও নাতি-নাতনির হাত ধরে গিয়ে বসতেন পার্কের বেঞ্চে। কিন্তু প্রায় দশ বছর বছর সেই পার্কের গেটেও তালা পড়েছে।

তাহলে এত বছরের পুরনো চন্দ্রকোনা শহরে কি বিনোদনের কোনও উপায়ই নেই? আছে। পুরসভার একটি অডিটোরিয়ামে মাঝে মাঝে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সংস্কারের অভাবে বর্ষায় অডিটোরিয়ামের ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে। সাউন্ড সিস্টেম-সহ আলোর ব্যবস্থাও খুব খারাপ।

Advertisement

এমনই অবস্থা চন্দ্রকোনা শহরের বিনোদনের।

ঘাটাল-চন্দ্রকোনা সড়ক এবং চন্দ্রকোনা মেদিনীপুর-দু’টি সড়কের পাশে এই চন্দ্রকোনা শহর। পুরনো এই পুরসভায় যে কোনওকালে পার্ক ছিল না, তা কিন্তু নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, আশির দশকে পুরসভার উদ্যোগে শহরের তিন নম্বর ওয়ার্ডের রঘুনাথপুরে একটি পার্ক চালু করা হয়েছিল। সেখানে বাগান, ছোটদের জন্য দোলনা, স্লিপার-সহ নানা বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সংস্কারের অভাবে সেখানে খুদেদের ভিড় কমতে থাকে। তারপর হঠাত্‌ করেই পার্কের গেটে তালা ঝুলে যায়। এত দিনেও সেই পার্কের সংস্কারের উদ্যোগ নজরে পড়ছে না। পুরসশহরের প্রবীণ বাসিন্দা অসিত ঘোষ বলেন, “না আছে মাঠ, না পার্ক। সারাদিন বাড়িতে বসে থাকা ছাড়া আর কী উপায়?”

বিনোদনের উপায় হিসেবে শহরে দু’টি সিনেমা হল ছিল। কিন্তু মাসখানেক আগে একটি সিনেমাহলে এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। পরে সেই কিশোরীর মৃত্যুও হয়। সেই ঘটনার পরই প্রশাসনের তরফে বন্ধ করে দেওয়া হয় হলটি। শহরে আরও একটি সিনেমাহল চালু রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সেই হলের পরিবেশ ভাল না হওয়ায় অভিভাবকরা বাড়ির সদস্যদের ওই হলে সিনেমা দেখতে ছাড়তে ভরসা পান না। তাহলে উপায়? স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভরসা সেই কেবল লাইন। কেবলে যে সিনেমা চালানো হয়, তাই দেখেই অবসর কাটে। কিন্তু নতুন কোনও সিনেমা দেখতে গেলে ছুটতে হয় খড়্গপুর-মেদিনীপুর শহরে। বাড়ির সামনে রকে বসে গৃহবধূ নমিতা সরকার বলেন, “বিয়ের পর ছেলেমেয়েদের নিয়ে বহুবার পূজায় সিনেমা দেখতে গিয়েছি। এখন আবার সেটা বন্ধ। বাধ্য হয়ে বাড়িতে বসেই সিনেমা দেখি। নতুন ভালো কোনও সিনেমা হল হলে আমরা আবার দেখতে যেতে পারি।”

খেলাধুলোর ক্ষেত্রেও এই শহরের যথেষ্ট নাম ছিল। ঠাকুরবাড়ি বাজারের টাউন ক্লাব, সুরের হাটে প্রগতি সঙ্ঘ, মল্লেশ্বরপুরের সংগ্রাম সঙ্ঘ-সহ একাধিক ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কবাডি, ব্যাডমিন্টন-সহ অনেক খেলারই প্রচলন ছিল এই শহরে। জেলা ছাড়াও ভিন রাজ্যে গিয়ে খেলায় অনেক পুরস্কার আদায় করে এনেছে এই শহর। আর এমন শহরেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হয়ে ওঠেনি খেলাধুলোর উপযুক্ত পরিকাঠামো। বহু বছর ধরে টাউন ক্লাব কর্তৃপক্ষ একটি স্টেডিয়াম করার জন্য উদ্যোগ নিলেও এখনও সেটি হয়নি। ক্লাবের সম্পাদক রঘুদাস হালদার বলেন, “আমাদের ক্লাবে ট্রফিতে ভর্তি। এখনও খেলা হয়। কিন্তু মাঠে নতুন প্রজন্মের ছেলেরা খুবই কম আসছে। ফলে ফিকে হচ্ছে ক্রীড়া চর্চার মানও। বহুবার পুর প্রশাসন থেকে জেলা প্রশাসনকে একটি স্টেডিয়াম করার জন্য লিখিতভাবে আবেদন করলেও এখনও স্টেডিয়াম গড়ে উঠেনি।”

শহরে নাট্যচর্চারও প্রচলন যথেষ্ট রয়েছে। শহরের গাছশিতলাতে প্রগতি যুব সংস্থা ফি বছর ধরে নাট্য প্রতিযোগিতা করে আসছে। ওই ক্লাবেরই উদ্যোগে শহরে একাধিক নাট্যানুষ্ঠানও হয়েছে। কিন্তু শহরের অডিটোরিয়ামের অবস্থা এতটাই খারাপ, যে সেখানে কোনও অনুষ্ঠান করা যায় না। এমনকী নাটকের অনুশীলনও করতে হয় ফাঁকা মাঠে। সংস্থার পক্ষ থেকে বসন্ত চট্টোপাধ্যায় জানান, কিশোর বয়স থেকেই এই নাট্য সংস্থার সঙ্গে তিনি যুক্ত। রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে তাঁরা নাটক অভিনয় করেছেন। তাঁর কথায়, “অডিটোরিয়াম যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখন কোনও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সংস্কারের অভাবে সেটি এখন জরাজীণর্।” তাঁর দাবি, “একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতার সময় টাউন হলেই হয়। কিন্তু সেখানে এখনও নানা সমস্যা রয়েছে। টাউন হলটি সংস্কার জরুরি।”

সিপিএমের চন্দ্রকোনা জোনাল কমিটির সম্পাদক গুরুপদ দত্ত বলেন, “আমাদের সময়েই এই টাউন হল, পার্ক তৈরি করা হয়েছিল। ক্ষমতায় থাকার সময় আমার তার সংস্কারও করেছিলাম।” কিন্তু পার্ক তো প্রায় বছর কুড়ি বন্ধ। সংস্কার কাজ হল না কেন? তাঁর উত্তর, “তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরও কেন সেই কাজ করেনি?” সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন পুরসভার খোদ উপ-পুরপ্রধান রণজিত্‌ ভাণ্ডারি। তাঁর কথায়, “পার্কটি ফের চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শহরের আট নম্বর ওয়ার্ডে একটি ফাঁকা জমিতে স্টেডিয়াম-সহ খেলার মাঠ এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করার কথা ভাবা হচ্ছে”। আর টাউন হল প্রসঙ্গে পুরপ্রধান রাম কামিল্যার বক্তব্য, “আগের থেকে অনেক আধুনিকীকরণ হয়েছে। আরও কাজ করা হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন