সুভাষচন্দ্রের আগমনে পুড়েছিল বাজি

স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় ন’বছর আগে, ১৯৩৮ সালের ৩ মে শালবনি এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তখন তিনি কংগ্রেসের সভাপতি। উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামিল করা। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান-সহ অনেকেই। রাস্তার পাশে ম্যারাপ বেঁধে সভা হয়। বাজি পুড়িয়ে সে দিনের জননেতাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।

Advertisement

বরুণ দে

শালবনি শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৫ ০০:৫৮
Share:

এক সময় ভিড় উপচে পড়ত। এখন পরিত্যক্ত ভিডিও হল। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রায় ন’বছর আগে, ১৯৩৮ সালের ৩ মে শালবনি এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তখন তিনি কংগ্রেসের সভাপতি। উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামিল করা। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে ছিলেন নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খান-সহ অনেকেই। রাস্তার পাশে ম্যারাপ বেঁধে সভা হয়। বাজি পুড়িয়ে সে দিনের জননেতাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল।

Advertisement

ইতিহাসকে পুঁজি করে যখন বহু জনপদ পর্যটকদের আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে, সেখানে শালবনি ভুলতে বসেছে নিজের ইতিহাসই! কলেজ পড়ুয়া শৌভিক দাস, মৌমিতা মাহাতোদের কথায়, “সুভাষচন্দ্র বসু এসেছিলেন বলে শুনেছি। তবে বেশি কিছু জানি না!” সুভাষচন্দ্রের স্মারকও রয়েছে অবহেলায়। ১৯৯৬ সালের ২১ অক্টোবর এই স্মারকের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন প্রবীণ স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রয়াত সুশীলকুমার ধাড়া। প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন প্রয়াত বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্তও। শালবনি থানা সুভাষচন্দ্র বসু জন্মশত বার্ষিকী উৎসব কমিটির উদ্যোগেই এই স্মারক তৈরি করা হয়। শালবনিতে সুভাষচন্দ্র যে কাঠের চেয়ারে বসেছিলেন, সেই চেয়ার এখনও রয়েছে। যে বাড়িতে রয়েছে, সেই বাড়িরই অন্যতম সদস্য সমীরঞ্জন সরকার বলছিলেন, “সুভাষচন্দ্র বসু এই চেয়ারে বসেছিলেন, এটা ভাবলেই একটা আলাদা অনুভূতি হয়।”

আগে ঘটা করে শালবনিতে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন পালন করা হত। এখন তা-ও হয় না! কেন? সুভাষপল্লি যুব সমিতির অন্যতম সদস্য মদনমোহন ঘোষ বলছেন, “সামর্থ্যের মধ্যে থেকে যতটুকু করা সম্ভব করি। সমিতির সদস্যরাই সব আয়োজন করেন।” সরকারি উদ্যোগে তেমন কোনও কর্মসূচি হয় না। স্থানীয় অনেকেরই আক্ষেপ, সরকারও ইতিহাস সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়নি।

Advertisement

বিট্রিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণায় অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই জনপদ। সময়টা ১৭৯৪ থেকে ১৭৯৯। ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, বর্গির হানা, ব্রিটিশদের কুখ্যাত আইন, জমির উপর অতিরিক্ত খাজনা প্রভৃতি কারণে কর্ণগড় এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূমিজ, সাঁওতাল, লোধা প্রভৃতি জাতির লোকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। নীলকর সাহেবদের নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৭০-’৭১ সালে নকশাল আন্দোলনের ঢেউও শালবনির বুকে আছড়ে পড়ে।

শালবনির নানা প্রান্তেই ছড়িয়ে রয়েছে নানা ইতিহাস। রানি শিরোমণির স্মৃতি বিজড়িত কর্ণগড়ের মা মহামায়ার মন্দিরের ওড়িশি স্থাপত্যকলা অনেককেই মোহিত করে দেয়। জলহরি গ্রামে গাজনের খ্যাতি রয়েছে। এখানকার আগুন সন্ন্যাস বিখ্যাত। গ্রামে শীতলা মন্দির, মনসা মন্দির রয়েছে। গাজনের সময় বড় পুজো হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সব গ্রামের অবদান রয়েছে, তার মধ্যে ভাদুতলা অন্যতম। এই এলাকার নামকরণের দু’টি তথ্য শোনা যায়। প্রথমত, এখানে ভাদুগাছ ছিল। গাছতলায় অনেকে দাঁড়াতেন। সেই থেকে গ্রামের নাম ভাদুতলা হয়ে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনজাতির মধ্যে ভাদুগান ও ভাদু পরবের প্রভাব রয়েছে। সেই থেকেও ভাদুতলা নাম হতে পারে।

এই চেয়ারেই বসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

এখন শহুরে ছাপ পড়ছে গ্রামে। তরজা, কবিগান, ভাদু-টুসুর বহমান সুরে পপ-রকের ছাপ পড়ছে। মন্দির, মসজিদ, বড়াম থানে কালের ছোপ। মাঝেমধ্যেই ভেঙে ফেলা হচ্ছে ঐতিহ্যের ইমারত। মন্দির, স্থাপত্য, শিল্প প্রভৃতি কালের নিয়মে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হলে পর্যটকদেরও টেনে আনা যেত এই শালবনিতে।

শাল-মহুয়ায় ঘেরা এই জনপদ। অথচ, শালবনিতে একটিও ইকো পার্ক নেই! জেলায় বেশ কয়েক’টি ইকো ট্যুরিজম পার্ক রয়েছে। এই সব পার্কে প্রচুর লোকজনও আসেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করেন। মূলত, দু’টি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এক সময় এই সব পার্কগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল। এক, ভ্রমণপিপাসুদের বিনোদন। দুই, স্থানীয়দের বিকল্প আয়ের সংস্থান। পার্ক তৈরি হলে একদিকে যেমন এলাকার সৌন্দর্য্য বাড়বে, প্রচুর মানুষ বেড়াতে আসবেন, অন্য দিকে তেমন পার্ককে ঘিরে স্থানীয় কিছু মানুষের কাছে রুজি-রোজগারের সুযোগ তৈরি হবে। শালবনির বিডিও জয়ন্ত বিশ্বাসও মানছেন, “এখানে ইকো পার্ক তৈরি হতেই পারে। এ বার পরিকল্পনা তৈরি করা হবে।” শালবনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নেপাল সিংহের আশ্বাস, “অনেক দিন ধরেই পার্কের ব্যাপারে ভাবছি। এ বার কিছু একটা করতেই হবে।”

এক সময় শালবনিতে দু’টি ভিডিও হল, একটি সিনেমা হল ছিল। এখন সবক’টিই বন্ধ। ফলে, হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে হলে স্থানীয়দের মেদিনীপুর কিংবা খড়্গপুরে যেতে হয়। তখন শালবনিতে এত ভিড় ছিল না। সময়ও যেন এত তড়িৎ-গতিতে ছুটত না। শালবনির ভিডিও হলে সপ্তাহ শেষে ভালই ভিড় হত। নতুন ছবি এলে তো কথাই নেই। হাউসফুল বোর্ডও ঝুলত। সাদা-কালো থেকে রঙিন পর্দা। দশকের পর দশক ধরে রমরমিয়েই চলেছে একের পর এক সিনেমা। হলগুলোর সামনে ভিড় করেছেন বহু মানুষ।

আজ সেই হলই কালের অতীতে তলিয়ে গিয়েছে। পড়ে রয়েছে বাড়িটুকু। মৌপাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূনকুমার পড়িয়ার কথায়, “শালবনিতে ইতিহাসের নানা নির্দশন রয়েছে। প্রাচীন মন্দির, স্থাপত্য রয়েছে। এগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণ জরুরি। না হলে নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক কিছুই অজানা থেকে যাবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন