সরকারি উদাসীনতায় ধুঁকছে তমলুকের পর্যটনকেন্দ্র

তমলুকের রাজবাড়ির নানা কথা লোকমুখে শোনা গিয়েছে তো অনেকই। কিন্তু কেমন অবস্থা সেই ঐতিহাসিক নির্দশনের? পর্যটকরা জানিয়েছেন, এখন রাজবাড়ির কঙ্কাল ছাড়া দেখার আর কিছুই নেই। মূল রাজবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরের সুখ্যাতি শুনে অনেক পর্যটকই বারবার এসেছেন দেবী দর্শনে। অথচ পর্যটকদের অভিযোগ, সেখানে যথাযথ গাড়ি রাখার ব্যবস্থাটুকুও নেই। ফলে সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের।

Advertisement

আনন্দ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০২
Share:

জীর্ণ তমলুক রাজবাড়ি

তমলুকের রাজবাড়ির নানা কথা লোকমুখে শোনা গিয়েছে তো অনেকই। কিন্তু কেমন অবস্থা সেই ঐতিহাসিক নির্দশনের? পর্যটকরা জানিয়েছেন, এখন রাজবাড়ির কঙ্কাল ছাড়া দেখার আর কিছুই নেই। মূল রাজবাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

Advertisement

তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরের সুখ্যাতি শুনে অনেক পর্যটকই বারবার এসেছেন দেবী দর্শনে। অথচ পর্যটকদের অভিযোগ, সেখানে যথাযথ গাড়ি রাখার ব্যবস্থাটুকুও নেই। ফলে সমস্যায় পড়তে হয় তাঁদের।

শহরের এক বাসিন্দা প্রদীপ্ত খাটুয়া বলেন, “বছর পনেরো আগেও তমলুকের স্টিমারঘাট দেখার মতো ছিল। কিন্তু সংরক্ষণ না হওয়ায় সেখানে এখন বাড়ির জঙ্গল। স্টিমারঘাটের অস্তিত্ব পাওয়া মুশকিল।”

Advertisement

তমলুকের বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই শহরে দর্শনীয় স্থান অনেক কিছুই রয়েছে। অথচ তা পর্যটক ও গবেষকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে সরকারি উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট। তমলুকের ইতিহাস কিন্তু এত অবহেলার নয়। ইতিহাস বলে, গুপ্ত সম্রাট বিক্রমাদিত্যের আমলে এই শহরে এসেছিলেন বিখ্যাত চিনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন। তার প্রায় ২০০ বছর পর এখানে এসেছিলেন চিনা পরিব্রাজক ই-চিং। মহামতি অশোক এখানে স্থাপন করেছিলেন অনুশাসন খোদিত প্রস্তর-স্তম্ভ। অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা তাম্রলিপ্ত বন্দর দিয়ে সিংহল তথা আজকের শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন বৌদ্ধধর্ম প্রচারে। ভারতের অন্যতম প্রাচীন বন্দর নগরী তাম্রলিপ্তে আজ আর বন্দরের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এক সমৃদ্ধ ইতিহাস বুকে নিয়ে আজও বহমান রয়েছে তমলুক শহরের জীবন ধারা। রূপনারায়ণ তীরবর্তী এককালের সমৃদ্ধ তাম্রলিপ্ত নগরী আজ শুধু তমলুক শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রত্নতাত্বিক, ধর্মীয় ও পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা নিদর্শন এই শহরে রয়েছে।

তমলুকে কী কী আছে পর্যটকদের দেখার জন্য?

তমলুক শহরের মাঝে দেবী বর্গভীমা মন্দির একান্ন পীঠের অন্যতম। কথিত আছে দেবীর বাঁ পায়ের গোড়ালি এখানে পড়েছিল। দেবী এখানে ভীমা রূপা, তাই তিনি বর্গভীমা। দেবীর মূর্তি একশিলা পাথরের আর মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীও অপূর্ব। তমলুক পুরসভা প্রকাশিত তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী, রূপনারায়ণের তীরে উঁচু মাটির ঢিবির উপর মন্দিরটি বানানো। অনেকের মতে, সম্রাট অশোক তাম্রলিপ্তে যে স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন তার উপরই মন্দিরটি নির্মিত হয়। কিন্তু মন্দির সংলগ্ন এলাকায় গাড়ি রাখার নির্দিষ্ট কোনও স্থান বা ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যায় পড়েন মন্দিরে আসা পর্যটকরা।

শহরের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ নদ।
এর তীরেই একসময় গড়ে উঠেছিল তাম্রলিপ্ত বন্দর।

শহরের রাজবাড়ির কাছে থাকা পুরাস্থাপত্য জিষ্ণুহরি মন্দিরের অবস্থা তথৈবচ। পুরসভার তথ্যপঞ্জী অনুযায়ী, প্রায় ৫০০ বছরের আগে এই জিষ্ণুহরি মন্দির স্থাপিত হয়েছিল। মূল মন্দির প্রায় ৩০ ফুট উঁচু, চারচালা, জগমোহনযুক্ত। জিষ্ণুহরি মন্দিরের পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত চঞ্চল অধিকারী বলেন, “কয়েক’শ বছরের প্রাচীন এই মন্দিরের স্থাপত্য সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পুরসভা ও প্রশাসনকে জানিয়েও সদর্থক সাড়া মেলেনি। আমরা চাই তমলুকের অন্যতম প্রাচীন এই মন্দির সংরক্ষণ করে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা হোক।” তমলুক রাজবাড়ির সামনেই রয়েছে ‘খাটপুকুর’ নামে এক বিশাল জলাশয়। কথিত আছে এই সরোবর প্রতিষ্ঠা করেন রাজা তাম্রধ্বজ। ভারতীয় পুরাতত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এই রাজবাড়ি সংরক্ষণ করে এখানে সংগ্রহশালা তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানা গিয়েছে। তমলুক শহরের আর একক দর্শনীয়স্থান জেলখানা মোড়ের কাছে গৌরাঙ্গ-মহাপ্রভু মন্দির। কিন্তু ওই মন্দিরের প্রবেশ পথ সংলগ্ন এলাকায় বাজার বসার ফলে পর্যটকদের কাছে ওই মন্দির চোখেই পড়ে না। এছাড়াও রয়েছে মানিকপীরের থান, লালদিঘির মসজিদ, জুম্মা মসজিদ।

ঐতিহাসিক নানা নিদর্শনও ছড়িয়ে রয়েছে এই শহরে। তমলুক শহরের অন্যতম দর্শনীয় হল পুরসভা অফিসের কাছে ‘তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র’। আদি প্রস্তর যুগ থেকে মধ্যপ্রস্তর যুগ অবধি আদিম মানুষের ব্যবহৃত প্রস্তরীভূত হাড়, পাথরের অস্ত্র, হরিণের শিঙের উপর খোদাই করা নকসাযুক্ত আসবাব, মৌর্য, শুঙ্গ যুগ থেকে পাল-সেন আমল অবধি প্রাপ্ত পোড়া মাটির মূর্তি ঠাঁই পেয়েছে এখানে। অথচ এমন একটি নিদর্শনকেন্দ্র চলছে ভাড়া বাড়িতে। তবে তমলুক আদালত, শহিদ ক্ষুদিরামের স্মৃতি বিজড়িত হ্যামিল্টন স্কুল, রক্ষিতবাটী, বৈকুণ্ঠ সরোবর, রূপনারায়ণ নদী, শহিদ মাতঙ্গিনী হাজরার শহিদস্থল, তাম্রলিপ্ত মিউজিয়াম ও নিমতৌড়ি স্মৃতিসৌধ-এই স্থানগুলিও পযর্টকদের খুবই পছন্দের।

শহরের আর এক বাসিন্দা কৃতিসুন্দর পাল বলেন, “রূপনারায়ণের নদীতীরের সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে ওই স্থানকে আরও আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।” এলাকার বাসিন্দাদের মতে, দর্শনীয় স্থানগুলিকে যদি সংরক্ষণ করে উপযুক্ত পরিকোঠামো তৈরি করা যায়, তা হলে পর্যটক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে এই জেলা শহরের আকর্ষণ বাড়বে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ারও সম্ভাবনা বাড়বে। পর্যটকদের আকর্ষণ করতে কয়েক বছর আগে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তমলুক শহরের রূপনারায়ণ নদী তীরবর্তী এলাকায় ‘বুদ্ধিস্ট ট্যুরিজম সেন্টার’ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্যোগের অভাবে তা চাপা পড়ে গিয়েছে। আর এই উপযুক্ত পরিকাঠমোর অভাবের কারণেই রূপনারায়ণ নদীর তীরে তৈরি পুরসভার অতিথি নিবাস ‘রূপনারায়ণ’ প্রায় ফাঁকাই অবস্থায় থাকে।

শহরের এক হোটেল ব্যবসায়ী তপন মাইতি বলেন, “এখনও এই শহরের হোটেলে যে অল্প সংখ্যক লোক রাত্রিবাস করেন তাঁদের বেশীর ভাগই হয় ব্যবসার প্রয়োজনে অথবা চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। শহরের দর্শনীয়স্থানগুলি দেখার জন্য পর্যটকদের দেখা নেই বললেই চলে।” সরকারিভাবে জেলাস্তরে গঠিত ডিস্ট্রিক্ট হেরিটেজ কমিটির সদস্য তথা তমলুকের উপ-প্রধান দীপেন্দ্রনারায়ণ রায় বলেন, “তমলুক শহরের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যায়নের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তা পুরসভার পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তবে তমলুক শহরের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলিকে সংরক্ষণ করে পর্যটন পরিকাঠামো উন্নত করার জন্য আমরা রাজ্য সরকারের কাছে প্রস্তাব জমা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি।”

কবে এই উদ্যোগ শুরু হয়, তারই অপেক্ষায় তমলুকের বাসিন্দারা।

ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন