দীর্ঘ ১৩ বছর পরে পুরকর বাড়তে চলেছে মেদিনীপুর শহরে। বর্ধিত পুরকর কার্যকর হবে ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে। চলতি মাস থেকেই শুরু হয়েছে নতুন হারে পুরকরের নোটিস বিলি। পুর-কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নোটিস দিচ্ছেন। আর সেই সঙ্গে উঠতে শুরু করেছে অভিযোগ।
শহরবাসীর বক্তব্য, কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনও সামঞ্জস্য রাখা হয়নি। ফলে, এক এক জনের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কর বেড়েছে। যেমন, কারও কর আগে ছিল ১০২ টাকা। তা বেড়ে হচ্ছে ৬৪৩ টাকা। আবার কারও কর আগে ছিল ১৬৮ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১,২৫৪ টাকা! এই পরিস্থিতিতে নতুন করে পুরকর নির্ধারণের দাবি করছেন শহরের একাংশ বাসিন্দা। মেদিনীপুরের পুরপ্রধান প্রণব বসু অবশ্য বলেন, “পুরসভা নয়, কর মূল্যায়ন করে ভ্যালুয়েশন বোর্ড। খসড়া মূল্যায়নে আপত্তি থাকলে তা পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করা যেতে পারে।” পুর-কর্তৃপক্ষের আরও যুক্তি, প্রায় ১৩ বছর পর শহরে নতুন কর বিন্যাস হচ্ছে। ফলে বর্ধিত কর কারও কারও কাছে বেশি বলে মনে হচ্ছে।
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, কর নির্ধারণ করে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ভ্যালুয়েশন বোর্ড’ বা ‘পশ্চিমবঙ্গ মূল্যায়ন পর্ষদ’। বাড়ি বাড়ি নোটিস বিলিও পর্ষদের তরফেই হয়েছে। পুর-কর্মীরা বছর কয়েক আগে বাড়ি জরিপ করেছেন। জমির পরিমাণ এবং সেখানে নির্মাণ কাজের মাপ দেখেই কর ধার্য করেছে পর্ষদ। তা ছাড়া, কারও বাড়িতে ভাড়াটে রয়েছে কিনা, কারও বাড়ির কোনও অংশ বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা, এ সবই কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়েছে। শহরের বাসিন্দা বিশ্বনাথ ভৌমিক, সুশান্ত মজুমদার, শুভাশিস মাইতিদের অবশ্য বক্তব্য “কী পদ্ধতিতে কর নির্ধারণ হল বুঝতে পারছি না। কারও কারও ১২ থেকে ১৫ গুণ পুরকর বেড়েছে। বর্ধিত করের বোঝা বইতে অনেকেরই অসুবিধে হবে।”
একই দাবি বিরোধীদের। পুরসভার বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএম কাউন্সিলর গোপাল ভট্টাচার্য বলেন, “বর্ধিত কর অনেকেই দিতে পারবেন না। এ ভাবে কয়েকগুণ হারে কর বাড়ানো হলে শহরবাসীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবেই।” সুর চড়িয়েছে কংগ্রেসও। শহর কংগ্রেস সভাপতি তথা কাউন্সিলর সৌমেন খান বলেন, “আমরা বর্ধিত পুরকর মানছি না! পুরবোর্ডের বৈঠকে ২০ শতাংশ কর বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তা মানা হয়নি। নতুন করে কর নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি।”
কিছু ক্ষেত্রে ভুল যে হয়েছে, তা মানছেন পুর-কর্তৃপক্ষও। পুরপ্রধান প্রণববাবুর কথায়, “পর্ষদ কম্পিউটারে নোটিস তৈরির কাজ করেছে। দু’-তিনটি ক্ষেত্রে হয়তো ভুল হয়ে থাকতে পারে। এ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি থাকলে তা লিখিত ভাবে জানানো যাবে।” পুরসভার দাবি, সে ক্ষেত্রে শুনানি হবে। অবশ্য শুনানিতে সমস্যা কতটা মিটবে, তা নিয়ে একাংশ শহরবাসীর মধ্যেই সংশয় রয়েছে।
পুরসভা সূত্রে খবর, দীর্ঘদিন কর না বাড়ানোয় এখন মাঝেমধ্যেই টান পড়ে পুরসভার কোষাগারে। অথচ কর বাবদ পাওয়া টাকা থেকেই বিদ্যুৎ বিল, অস্থায়ী কর্মীদের একাংশের বেতন, জরুরি মেরামতের মতো কাজগুলো হয়। জেলার এই সদর শহরে এখন জনসংখ্যা প্রায় পৌনে দু’লক্ষ। ২৫টি ওয়ার্ডে বাড়ি রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। হিসেব মতো পুরকর বাবদ (হোল্ডিং ট্যাক্স) এখন পুরসভার বছরে আয় হওয়ার কথা প্রায় ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাসে প্রায় সাড়ে ৩৩ লক্ষ টাকা। কিন্তু ধার্য কর সময়মতো আদায় হয় না। অনেকেরই দীর্ঘদিন কর বকেয়া রয়েছে। এখন পুরসভার লক্ষ্য, বছরে কর বাবদ ৮ কোটি টাকা আদায় করা।
বছর দুয়েক আগেও চরম আর্থিক সঙ্কটে ছিল তৃণমূল পরিচালিত পুরসভা। মাসে যেখানে আয় হত গড়ে ৪১ লক্ষ ৮৭ হাজার টাকা, সেখানে ব্যয় ছিল ৪১ লক্ষ ৩৫ হাজার টাকা! এখন অবশ্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মেদিনীপুরের উপ-পুরপ্রধান জিতেন্দ্রনাথ দাস মানছেন, “পুরকর থেকে যা আয় হয়, তার একটা বড় অংশ তো বিদ্যুৎ বিলই মেটাতে চলে যায়। মাসে প্রায় ৩৪ লক্ষ টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। এই পরিস্থিতিতে বর্ধিত পুরকর কার্যকর না হলে আগামী দিনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন।”
পুরসভা সূত্রে খবর, ইতিমধ্যে অভিযোগপত্র পুরসভায় জমা পড়তে শুরু করেছে। সোমবারও অনেকে পুরসভায় এসে বর্ধিত কর নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছেন। অবশ্য নোটিসে জানানো হয়েছে, নোটিস প্রাপ্তির দু’মাসের মধ্যে আপত্তির কথা জানানো যাবে। বকেয়া পুরকর আদায়েও পুরসভা জোর দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বর্ধিত করে পুরসভার কোষাগারের হাল ফেরে কি না, সেটাই এখন দেখার!
শুরু আগামী এপ্রিলে
• বর্তমানে পুরকর (হোল্ডিং ট্যাক্স) বাবদ আয় ৪ কোটি টাকা। তা বাড়িয়ে ৮ কোটি করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে মেদিনীপুর পুরসভা।
• ইতিমধ্যে নতুন কর-বিন্যাসের নোটিস বাড়ি বাড়ি বিলি শুরু হয়েছে। আপত্তি থাকলে দু’মাসের মধ্যে আবেদন করা যাবে।
• শহরবাসীর অভিযোগ, নতুন কর নির্ধারণে কোনও সামঞ্জস্য নেই। কারও কারও ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত কর বেড়েছে।
• পুরসভার বক্তব্য, নিয়ম মেনেই কর নির্ধারণ করেছে রাজ্যের ভ্যালুয়েশন বোর্ড।