বিয়ে করব না, ফুটবল খেলব, থানায় হাজির ১৫ বছরের সায়রা

সায়রা খাতুনের চাষি বাবার মনে তাই ভারী দুখ। মেয়েটা তো দেখছি, সমাজে নাক-কান কাটাবে! মেয়েকে বোঝালেন, ও পায়ে কি ফুটবল হয় রে! বরং বিয়ে করে নে। কিন্তু, কাকভোরে উঠেই মাঠে দৌড়তে চলে যাওয়া মেয়েকে যে সহজে মানাতে পারবেন না, তা বোঝেননি পুরুলিয়ার মানবাজার থানার জবলা গ্রামের বাসিন্দা পতৌদি আনসারি।

Advertisement

সমীর দত্ত

মানবাজার শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:২৮
Share:

সায়রা খাতুন। নিজস্ব চিত্র

সাত সকালে উঠে কোথায় বাসন-কোসন মেজে রাখবে বা উঠোন নিকোবে তা নয়, মেয়ে যাচ্ছে মাঠে ফুটবল পেটাতে!

Advertisement

সায়রা খাতুনের চাষি বাবার মনে তাই ভারী দুখ। মেয়েটা তো দেখছি, সমাজে নাক-কান কাটাবে! মেয়েকে বোঝালেন, ও পায়ে কি ফুটবল হয় রে! বরং বিয়ে করে নে। কিন্তু, কাকভোরে উঠেই মাঠে দৌড়তে চলে যাওয়া মেয়েকে যে সহজে মানাতে পারবেন না, তা বোঝেননি পুরুলিয়ার মানবাজার থানার জবলা গ্রামের বাসিন্দা পতৌদি আনসারি।

বুধবার দুপুরে বাড়িতে এই নিয়ে অশান্তি চরমে ওঠায় একাই বাসে চড়ে ১৪ কিলোমিটার দূরে মানবাজার থানায় হাজির পনেরো বছরের সায়রা। পুলিকর্মীদের বলে, ‘‘আমি এখন বিয়ে করব না। বাড়িও ফিরব না।’’ জেলা চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর অশোক মাহাতো জানান, খবর পেয়ে থানায় সায়রার বাবা-মাকে ডেকে এনে দেড় ঘণ্টা ধরে চলে কাউন্সেলিং। অবশেষে মুচলেকা দিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন তাঁরা। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার বাঁকুড়ার প্রশাসনিক সভার মঞ্চে কন্যাশ্রী মেয়েদের হাতে যখন ফুটবল তুলে দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী, তার ঠিক আগের দিন এমন কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে পুরুলিয়ার মেয়েটি। সেই পুরুলিয়া, যে জেলার রেখা কালিন্দী, বীণা কালিন্দী, আফসানা খাতুনদের হাত ধরে রাজ্যে নাবালিকা বিয়ে রোখা আন্দোলনের চেহারা নিয়েছিল।

Advertisement

সায়রার মা নাসিমা বিবি বলেন, ‘‘পড়াশোনায় খারাপ ছিলাম না। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমার মেয়েটা পড়ায় ভাল, খেলাতেও।’’ তাহলে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে কেন? সায়রার বাবা পতৌদি আনসারি বলেন, ‘‘বেশ কিছুদিন ধরে ভোরে উঠে দৌড়তে যাচ্ছিল। বিশ্বাস হয়নি। ভেবেছিলাম খারাপ কোনও ছেলের পাল্লায় পড়েছে হয়তো। আর সমাজেও তো পাঁচ কথা ওঠে!’’

আরও পড়ুন: হাতিয়ার হোক মোদীর কথাই, চান বিরোধীরা

‘বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম’ মনে আছে? সেই যে দিদির বিয়ের দিন রক্ষণশীল বাড়ির সঙ্গে লড়াই করে ফুটবল ফাইনাল খেলতে গিয়েছিল লন্ডন নিবাসী জসমিন্দর। সেই ফুটবল আঁকড়েই রুখে দাঁড়িয়েছে সায়রা। গোপালনগর হাইস্কুলের নবম শ্রেণির এই ছাত্রী কন্যাশ্রী ফুটবল দলের সদস্য। ক্রীড়া শিক্ষক অপূর্ব মণ্ডল বলেন, ‘‘মেয়েটা ফরোয়ার্ডে খেলে। প্রতিভা আছে। প্র্যাক্টিস চালিয়ে যেতে বলেছিলাম।’’ কোচের কথা মতো বান্ধবী রিয়া মাহাতো, অনন্যা মাহাতোদের সঙ্গে দৌড়ত সায়রা। রিয়ার কথায়, ‘‘সায়রার ধ্যান-জ্ঞান শুধু ফুটবল।’’ সেই খেলা যাতে বন্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতে বৃহস্পতিবার অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে সায়রার বাড়ি গিয়েছিলেন প্রধান শিক্ষক তপন মাহাতো। নাসিমা বলেন, ‘‘ওঁরাও পাশে থাকবেন বলেছেন। আমরাও তো চাই মেয়েটা বড় হোক।’’

সিনেমার জসমিন্দরের বেঁকানো শট সবার মাথা টপকে বল জড়িয়ে দিয়েছিল জালে। সে-ও সব বাধা পেরোবে, আশাবাদী সায়রা। ‘‘পড়াশোনাটা আগে শেষ করব। তার পরে কনস্টেবলের চাকরি নিয়ে বাবা মা-র পাশে দাঁড়াব।’’— থানায় দাঁড়িয়ে প্রত্যয়ী গলায় বলল মানবাজারের জসমিন্দর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন