ধ্বংস দু’তরফে, রেহাই পান না ঘরের ছেলেও, বলছেন নিহত জওয়ানের স্ত্রী

কিছু ছেলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে হয়তো এই চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু তার আগে তাঁকে অনেক শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হয়, যেটা সবার থাকে না।

Advertisement

মিতা সাঁতরা (পুলওয়ামায় জঙ্গি-হানায় নিহত সিআরপি জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী)

উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৯ ০৩:০৯
Share:

মিতা সাঁতরা

আমরা ২০০৯ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হই। কোনও দিন ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি আমাকে বন্ধনমুক্ত করে উনি চলে যাবেন। এক নির্ভীক, বলশালী পুরুষের স্ত্রী হিসেবে আমি গর্ব অনুভব করতাম। জওয়ানের স্ত্রী হিসেবে প্রথম ধাক্কাটা খেয়েছিলাম, যখন ছত্তীসগঢ়ের দান্তেওয়াড়ায় একসঙ্গে ৭৬ জন সিআরপিএফ জওয়ানের প্রাণ নিয়েছিল মাওবাদীরা। সে দিন আমি এই চাকরির ভয়াবহতা উপলব্ধি করি। বুঝতে পারি, এটা সাধারণ চাকরি নয়। কিছু ছেলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে হয়তো এই চাকরি গ্রহণ করেন। কিন্তু তার আগে তাঁকে অনেক শারীরিক সক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হয়, যেটা সবার থাকে না।

Advertisement

এই চাকরির শর্তই হল— পরিবার পরে, দেশের প্রতি দায়িত্ব, কর্তব্য আগে। তাই জওয়ানরা তাঁদের সন্তানের জন্মদান বা পারিবারিক যে কোনও সুখের মুহূর্তে উপস্থিত থাকতে পারেন না। আর পাঁচটা সাধারণ চাকরির মতো বাড়ির খাবার খেয়ে বেরোতে পারেন না বা বাড়ি ফিরে রোজ মা, স্ত্রী-সন্তানের মুখও দেখতে পারেন না। অপর দিকে, তাঁদের পরিবারকেও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। সব দায়িত্ব, কর্তব্য একা পালন করতে হয় এবং অপেক্ষা করতে হয় কবে আবার বাড়িটা প্রাণ ফিরে পাবে। কিন্তু এই অপেক্ষার অবসান যদি কফিনবন্দি দেহের মাধ্যমে হয়?

তাই আমি যুদ্ধ চাই না। আমি শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। যুদ্ধ মানে আর্থিক, সামাজিক এবং অবশ্যই মানবসম্পদের ক্ষতি। যুদ্ধ ধ্বংস ডেকে আনে। তাই যে কোনও বড় যুদ্ধের পরেই শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আমি চাইব, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের রাস্তা বের করতে। আজ আমার সব অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। আর সময়ে-অসময়ে ফোন বেজে ওঠে না। আর আমাকে উনি বলেন না, ‘‘দেখো তো, অমুক তারিখে ছুটি পেলে ভাল হবে? নাকি আর একটু পরে যাব?’’ আর ভিডিয়ো কল করে মেয়ের সঙ্গে খুনসুটিও হয় না।

Advertisement

আরও পড়ুন: রাজনীতির প্রয়োজনে যুদ্ধ চাই না, দেশের প্রয়োজনে আমরা রয়েছি: মমতা

আমি যুদ্ধ না-চাইলেও যুদ্ধ বাধলে জওয়ানেরা যুদ্ধে যাবেন। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বাহিনী স্থানান্তরের সময়ে যদি এই রকম (যেটা পুলওয়ামা-হামলায় হয়েছে) ঘটে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। কেন সে দিন এত অসতর্ক ভাবে বাহিনী স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল? আজ জম্মু-শ্রীনগর বিমান পরিষেবা চালু হয়েছে বাহিনীর জন্য। কিন্তু ভারতবর্ষের সর্বত্র কি বাহিনীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়েছে? ভারতবর্ষকে রক্ষার জন্য যে সেনাবাহিনী সরকার গঠন করেছে, তাকে রক্ষার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। সরকারের কাছে আমার আবেদন এটুকুই থাকবে। আমার এবং আমার ছোট্ট মেয়ের মতো হতভাগ্য যেন আর কেউ না হন।

আরও পড়ুন: 'আমি পাকিস্তানি, কিন্তু যুদ্ধ চাই না'

আরও একটা কথা, আমি ঠিক যা বলতে চেয়েছিলাম, তাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে বায়ুসেনার উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানের ঘটনার মধ্যে দিয়ে। আমাদের ঘরের ছেলে অভিনন্দন পাকিস্তান সেনাদের হাতে আটক হয়েছেন। অভিনন্দন সুস্থ থাকুন, ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করি। আমাদের সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তিনি সুস্থ শরীরেই ঘরে ফিরে আসছেন। কিন্তু তাঁর পরিবারের যে দুশ্চিন্তা তা কিছুটা হলেও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছি আমি।

যুদ্ধ কখনও এক পক্ষকে ধ্বংস করে না। ধ্বংস দু’তরফেই হয়। তাতে ঘরের ছেলেও রেহাই পান না। জানি, এই সব কথা বলার জন্য আমি সমালোচনার শিকার হব। সামাজিক মাধ্যমে আমাকে অনেক বাঁকা কথা বলা হবে। আমার তাতে কিছুই যায় আসে না। যেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, সেই কথাটিই বলেছি। আর এটাও মনে করি, গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসাবে স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকার আমার আছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন