কাউন্সিলরদের সঙ্গে বৈঠক মুখ্যমন্ত্রীর। শুক্রবার নজরুল মঞ্চে। —নিজস্ব চিত্র।
মানুষের ‘ভোটের কথা ভেবে’ দলীয় কাউন্সিলরদের এ বার ‘নোটের খিদে’ ছাড়তে হুঁশিয়ারি দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
রাজ্য জুড়ে সমস্ত পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলরদের শুক্রবার কলকাতায় এক কর্মশালায় ডেকেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। দলীয় সূত্রের খবর, সেখানেই এ দিন তাঁদের স্পষ্ট বার্তা দিয়ে মমতা বলেন, যদি মনে করেন, ভোট নয় নোটই আসল, তা হলে কিন্তু দু’দিনেই চলে যেতে হবে! কেন চলে যেতে হবে, তা ব্যাখ্যা করে এর পরই দলনেত্রী কঠিন গলায় বলেন, কারণ কদ্দিন খাবেন? দু’বছর! তার পর ধরা পড়লে আইন তো ছাড়বেই না, মনে রাখবেন দলও ছাড়বে না। তাই কাউন্সিলরদের মমতা বলেছেন, ঠিক করে নিন, শুধু খাওয়া-দাওয়াই করবেন, নাকি লং টার্মে দলটা করবেন!
বস্তুত, রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণে একের পর এক শহুরে এলাকায় তৃণমূলের এক শ্রেণির কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, বেআইনি ব্যবসায় মদত, সিন্ডিকেট, তোলাবাজি ও জুলুমের যে লাগাতার অভিযোগ উঠছে, তা এখন গলগ্রহ হয়ে উঠেছে দলনেত্রীর। তাই পরিস্থিতি শোধরানোর বার্তা দিতেই এ দিনের কর্মশালা আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। নজরুল মঞ্চে আয়োজিত ওই সভার বক্তৃতাতেই তৃণমূল নেত্রী এ দিন বলেন, কে কোথায় কী করছেন, সব খবরই কিন্তু তিনি পান। তাঁর মোবাইলে আসে। তাই ফের তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘ডার্টি গেম’ খেলবেন না! সেই সঙ্গেই মনে করিয়ে দেন, এটাই ‘লাস্ট ওয়ার্নিং’! এ বার তিনি কাজ করে দেখাবেন।
‘কাজ’-এর নজির অবশ্য মমতা এর মধ্যেই কিছুটা রেখেছেন। তোলাবাজির অভিযোগে বিধাননগরের কাউন্সিলর অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর নির্দেশেই গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে বিধাননগর-রাজারহাটে আরও কিছু ছোট নেতা বা নেতার শাগরেদ গ্রেফতার হয়েছেন। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, তৃণমূল নেত্রীর এই প্রতীকী পদক্ষেপেও যে রাজ্য জুড়ে সার্বিক পরিস্থিতি শুধরোয়নি, তা এ দিনের কর্মশালা আয়োজনের মধ্যে দিয়েই প্রতিফলিত। সেই সঙ্গে এ-ও পরিষ্কার যে, দলের কাউন্সিলরদের একাংশের বেচাল নিয়ে বেশ উদ্বেগে মমতা। কারণ, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে কমবেশি এই কথাগুলি দলের নেতাদের বেশ কয়েক বার বলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে জানিয়েছিলেন, কাউন্সিলরদের নিয়ে শুধু পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং কলকাতার মেয়র তথা আবাসনমন্ত্রী শোভন চট্টোপাধ্যায় কর্মশালা করবেন। কিন্তু পরে দলনেত্রী ঠিক করেন, যা বলার তিনি নিজেই বলবেন।
মমতা এ দিন দৃশ্যতই ধমক দেওয়ার মেজাজে ছিলেন। সিন্ডিকেট-চক্রের নিন্দা করে সাম্প্রতিক কালে বিধাননগরের কাউন্সিলরদের বেশ কয়েক বার সমালোচনা করেছেন তিনি। মেয়র সব্যসাচী দত্তকেও সরাসরি হুঁশিয়ার করেছেন। দিদি এ দিনও শুরু করেন সেখান থেকেই। বলেন, তাঁদের এলাকা পরিষ্কার নেই কেন?
কেন ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে? কই সিন্ডিকেটের বেলায় তো ভুল হয় না! তাঁদের লজ্জা হওয়া উচিত, তাঁদের দেখেই গোটা রাজ্য সিন্ডিকেট শিখছে। পুর-এলাকা অপরিষ্কার থাকা ও ডেঙ্গির সংক্রমণের সূত্রেই তিনি চেপে ধরেন শ্রীরামপুরের কাউন্সিলরদেরও। প্রশ্ন করেন, তাঁরা নিজের এলাকা পরিষ্কার রাখতে পারেন না কেন? বাইরে থেকে কেন মুখ্যমন্ত্রীকে লোক পাঠাতে হবে? আবার পারস্পরিক রেষারেষি ও বিবাদের কারণে ভর্ৎসনা করেন দুর্গাপুর ও আসানসোলের কাউন্সিলরদের। তার পরে দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যান পাচু রায়কে উঠে দাঁড়াতে বলে সটান জানিয়ে দেন, সেখানকার দুই কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ৩০-৪০ লক্ষ টাকা তোলা আদায়ের অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। ওঁদের ডানা ছাঁটা এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
শুধু মুখে বলা নয়, তৃণমূলের প্রতিটি কাউন্সিলরের হাতে এ দিন ‘আদর্শ আচরণবিধি’ও ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিন পৃষ্ঠার ওই পুস্তিকায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, বাড়ির নকশা, মিউটেশন, জল ও নিকাশির সংযোগ, ট্রেড লাইসেন্সের জন্য কোনও কাউন্সিলর কোনও সুপারিশ করতে পারবেন না। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বই স্বীকার করছেন, দলের কাউন্সিলরদের একাংশের কাছে এ সবই এখন লক্ষ্মীলাভের রাস্তা। বাম জমানা থেকে পুরসভাগুলিতে এই রোগ শুরু হয়েছিল, যা এখন মহামারির আকার নিয়েছে। বাস্তবে বহু কাউন্সিলর ভুলেই গিয়েছেন, তাঁদের আসল কাজ কোনটা। তাই তাঁদের প্রকৃত ‘দায়িত্ব ও কর্তব্য’ ওই পুস্তিকার মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তাঁদের প্রধান কাজ হল এলাকার উন্নয়ন, সাফাই এবং সৌন্দর্যায়নে মন দেওয়া। সেই সঙ্গে কোথাও জবরদখল হচ্ছে কি না, কেউ কর ফাঁকি দিচ্ছেন কি না, সে দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি পুরসভাগুলির উপরে সর্বদা নজর রাখার জন্য শোভন-ফিরহাদের নেতৃত্বে ‘তৃণমূল পুর-দল’ নামে একটি কমিটিও এ দিন তৈরি করে দেন মমতা।
এখন প্রশ্ন হল, এ সবই কি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিয়ে আসার জন্য করছেন তৃণমূল নেত্রী? জবাবটা দলের নেতারাই দিয়েছেন। মমতার আগে এ দিনের বৈঠকে বক্তৃতা করেন দলের দুই শীর্ষ নেতা সুব্রত বক্সী ও মুকুল রায়। কাউন্সিলরদের তাঁরা মনে করিয়ে দেন, বিধানসভা ভোটে দল বিপুল সাফল্য পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু দেখা গিয়েছে, দখলে থাকা রাজ্যের ১১২টি পুরসভার মধ্যে ৬৭টিতেই পরাস্ত হয়েছে তৃণমূল। দলের এক শ্রেণির কাউন্সিলরের জন্য স্থানীয় ভাবে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা তৈরি হয়েছে। ফল ভুগতে হচ্ছে গোটা দলকে।
এখন প্রশ্ন হল, দিদির ‘লাস্ট ওয়ার্নিংয়েও’ কাজ হবে তো! তৃণমূল নেতারাই বলছেন, দেখা যাক।