স্ত্রী চন্দনাকে শেষ এই ছবিটিই হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়েছিলেন গৌতম ঘোষ।
চোখের সামনে পর্বতারোহী অভিযাত্রীদের মৃত্যু দেখেছেন। এক বার নয়, দু’বার নয়, তিন-তিন বার। তার জেরে আগে এভারেস্ট অভিযান মাঝপথে বাতিল করে ফিরতে হয়েছিল। এ বার অভিযানে গিয়ে শৃঙ্গ ছুঁলেন। কিন্তু ফেরার পথে শনিবার নিখোঁজ হয়ে গেলেন কলকাতা পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইনস্পেক্টর গৌতম ঘোষ। সোমবারও তাঁর খোঁজ মেলেনি।
আর এই খবর আসার পর থেকেই থমথমে গৌতমের ব্যারাকপুরের আনন্দপল্লির বাড়ি। স্বামী নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন, এই আশায় গত আট দিন ধরে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে রয়েছেন গৌতমের স্ত্রী চন্দনা ঘোষ। নাম দিয়েছেন অখণ্ড প্রদীপ। অল্প হাওয়াতেই কেঁপে কেঁপে উঠছে সেই প্রদীপের শিখা। প্রাণপণে সেই শিখা হাত দিয়ে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চন্দনাদেবী।
আনন্দপল্লিতে গৌতমবাবুদের যৌথ পরিবার। তিন ভাইয়ের মধ্যে সব থেকে ছোট গৌতমবাবু। তাঁর বড়দা দেবাশিসবাবু জানান, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর থেকে পাহাড়ে চড়ার নেশা পেয়ে বসেছিল গৌতমকে। উত্তর কাশীর নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং-এ প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন তিনি। বলতে গেলে পাহাড়ে চড়ার নেশাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। দেবাশিসবাবুর কথায়, ‘‘কখনও সখনও সামান্য স্পনসর জুটেছে। কিন্তু মূলত নিজের খরচেই বার বার অভিযানে গিয়েছেন তিনি।’’ গৌতমের স্ত্রী চন্দনাদেবী জানান, টাকা জোগাড় করতে তাঁর গয়নাও বন্ধক দিতে হয়েছে। তবুও হাল ছাড়েননি পাড়ার সকলের প্রিয় গৌতম।
কলকাতা পুলিশের ট্র্যাফিক বিভাগের কর্মী গৌতমবাবু। কিন্তু ডেপুটেশনে লালবাজারে হেড কোয়ার্টাস বাহিনীতে কাজ করতেন। পুলিশমহলে তাঁর পরিচয় ‘পাহাড় গৌতম’ নামে। প্রায় ২৫ বছর ধরে মাউন্ট কামেট, নীলকণ্ঠ, ত্রিশূল, চন্দ্র পর্বতের মতো অসংখ্য ছোট-বড় শৃঙ্গ জয় করেছেন গৌতম। প্রথম বার এভারেস্ট অভিযান গিয়েছিলেন ২০০৯-এ। সফল হননি। কিন্তু তা বলে ভেঙে পড়েননি। সেই সময় লালবাজারের বাইরে চায়ের দোকানে বসে গৌতম এক দিন বলেছিলেন, ‘‘এভারেস্ট অভিযান করবই করব।’’
গৌতমের মনের জোর টের পেতেন বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেওয়া তাঁর সঙ্গীরা। এমনই এক জনের কথায়, ‘‘২০০৮-এ মাউন্ট ছাঙ্গুছে গিয়ে প্রবল তুষারঝড়ে পড়তে হয়েছিল আমাদের। সে বার চোখের সামনে দু’জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল তুষারঝড়। তবু এভারেস্ট জয়ের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন গৌতমদা।’’
সেই দৃঢ়তা নিয়েই ২০১৪ সালে দ্বিতীয় বার এভারেস্ট অভিযানে যান গৌতম। ১৮ এপ্রিল প্রবল তুষারধসের কবলে পড়তে হয় তাঁদের। ঘটনার পরেই ফোনে বলেছিলেন, ‘‘ভাই কোনও রকমে বেঁচে গিয়েছি। সামনে ছড়িয়ে ছটিয়ে রয়েছে শেরপাদের মৃতদেহ। তার মধ্যে দাঁড়িয়েই কথা বলছি।’’ কলকাতায় ফিরে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ছবি দেখিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন, ‘‘ভায়া, এ বারও হল না।’’
শৃঙ্গ ছোঁয়ার স্বপ্নপূরণ করতে ফের অভিযানে যান ২০১৫-তে। দিনটা ছিল ২৫ এপ্রিল। নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্পের দিন তাঁদের আশ্রয় ছিল এভারেস্টের বেসক্যাম্প। অভিযান বাতিল করে সেখান থেকেই ফিরে আসতে হয়। বার বার তিন বার, তবু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি পুলিশের এই পর্বতারোহী। ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, ‘‘পর পর অভিযান করায় অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল। একটু বেকায়দায় আছি। তবে আমি আবার ট্রাই নেব।’’
‘ট্রাই’ নিয়েছিলেন গৌতম। ৭ এপ্রিল কলকাতা থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা দেন তিনি। ৮ মে ফেসবুক-চ্যাটে জানান, ভাল আছেন। নেপালের নম্বরটি দেন। বেস ক্যাম্পে থাকা অবস্থার একটি ছবি পাঠান। তার পর চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করা যায়নি। ফোনে নেপালি ভাষায় উত্তর আসে, ‘সুইচড অফ’।
লালবাজারের কয়েক জন সহকর্মীর সঙ্গে অবশ্য ১৫ মে যোগাযোগ হয়েছে গৌতমের। ওই দিন গৌতম তাঁদের জানিয়েছিলেন, ১৭ এবং ১৮ তারিখ ক্যাম্প- ২ তে থাকবেন। পরের দিন ৩ নম্বর ক্যাম্পে থাকবেন। ২০ মে সকালে পৌঁছবেন ৪ নম্বর ক্যাম্পে। শৃঙ্গ জয়ের লক্ষ্যে ওই দিন বিকালেই তাঁরা অভিযান শুরু করবেন। ২১ মে ভোরে পৌঁছে যাবেন এভারেস্টে।
কথা রেখেছিলেন গৌতম। ওই দিনই সকালে ছুঁয়েছিলেন স্বপ্ন। তার পর থেকে আর যোগাযোগ হয়নি।
শনিবার থেকেই নিখোঁজ গৌতমকে নিয়ে তাঁর পরিবার ও সহকর্মীরা উৎকণ্ঠায়। কলকাতা পুলিশের এক আইপিএস অফিসারের কথায়, ‘‘২০১০-এ বাহিনীর কয়েক জন সদস্য হিমাচল প্রদেশে ঘুরতে গিয়ে হড়পা বানের কবলে পড়েন। সে দিন দীর্ঘসময় লালবাজারে থেকে নিজস্ব যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বাহিনীর ওই কর্মীদের খোঁজখবর নিয়েছিলেন গৌতম। আজ তাঁরই খোঁজ নেই!’’ সময় যত গড়াচ্ছে, ভয় চেপে বসেছে গৌতমের পরিবারের সদস্যদের মনে। বাড়ির টিভি বন্ধ। সকাল থেকেই বাড়িতে আত্মীয়দের ভিড়। বাড়ির সামনে হাজির সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের গৌতমবাবুর ছেলে, দশম শ্রেণির ছাত্র দেবাঞ্জন জানায়, বাবার সঙ্গে সেও দু’বার পাহাড়ে চড়েছে। এমনকী বাবার উৎসাহেই রক ক্লাইম্বিংয়ের কোর্স করেছে।
গৌতমবাবুর পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজনৈতিক নেতারাও। সোমবার দুপুরে গৌতমবাবুর বাড়িতে আসেন ব্যারাকপুর পুরসভার পুর-প্রধান উত্তম দাস।