কিষেনজি প্রসঙ্গে তৃণমূলের যুব সভাপতির মন্তব্য ঘিরে বিতর্কের জল আরও গড়াল! ‘যুবরাজে’র রাজনৈতিক ‘অনভিজ্ঞতা’ নিয়ে এ বার কটাক্ষ করলেন তৃণমূল নেত্রীর প্রাক্তন সেনাপতি মুকুল রায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কিষেনজিকে খুন করেছে বলে শুক্রবার বেলপাহাড়ির সভায় তৃণমূল নেত্রীর সাংসদ ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করার পরেই সমালোচনায় সরব হন বিরোধীরা। মুখ খুলেছিল কিছু মানবাধিকার সংগঠনও। এর মধ্যে শনিবার মুকুলের বক্তব্যে শাসক দলের অস্বস্তি স্বভাবতই আরও প্রকট হয়েছে।
অভিষেক-মন্তব্য নিয়ে কলকাতায় এক অনুষ্ঠানের পরে এ দিন প্রশ্নের জবাবে মুকুলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ছোট ছেলে কী বলেছে, কী বৃত্তান্ত জানি না। তবে যে সময়ের ঘটনা, তখন আমি দলের খুব কাছে থেকে কাজ করছিলাম। যতদূর জানি, সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে। কী অর্থে কী বলেছে, দেখে বলতে হবে।’’ সংঘর্ষেই কিষেনজির হত্যা হয়েছে বলে ঘটনার পরে মমতা নিজেই দাবি করেছিলেন। কার্যত তারই পুনরাবৃত্তি করে এর পরেই অভিষেকের উদ্দেশে মুকুলের তির্যক মন্তব্য, ‘‘তবে যখন কিছু বলতে হয়, সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই অনেক পরিণত হতে হয়।’’
বিড়ম্বনা সামলাতে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব বলতে শুরু করেছেন ‘তারুণ্যের আবেগে’ অভিষেক বেলপাহাড়িতে ওই মন্তব্য করে ফেলেছেন। অভিষেকের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা হয়েছে বলে এ দিন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা ও মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বরং অভিষেককে বেলপাহাড়িতে গিয়ে সভা করার জন্য তাঁকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন। এবং মুকুলের মন্তব্যে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর পাল্টা বক্তব্য, ‘‘যাঁরা অভিষেককে অনভিজ্ঞ বলছেন, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের ছোট করছেন।’’
তাঁর বক্তব্যে বিতর্ক শুরু হওয়ার পরে শুক্রবার আনন্দবাজারকে অভিষেক বলেছিলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে কেন্দ্র-রাজ্যের যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে কিষেণজির মৃত্যু হয়। এটাই বলতে চেয়েছি। বিরোধীরা এটা নিয়ে অকারণ রাজনীতি করছেন।’’ আর ২৪ ঘণ্টা পরে শনিবার প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য না করলেও ঘনিষ্ঠ মহলে অভিষেক অবশ্য আক্ষেপ করেছেন যে মুখ ফস্কেই তিনি ‘খুন’ শব্দটি বলে ফেলেছেন। তবে কিষেনজির নেতৃত্বে অসংখ্য খুন এমনকী একটি থানার ওসিকে অপহরণের মতো ঘটনা বিরোধীরা বিস্মৃত হয়েছেন কি না, তা নিয়েও ঘনিষ্ঠমহলে প্রশ্ন তুলেছেন অভিষেক।
দলের তরফে এমনকী ব্যক্তিগত স্তরে অভিষেক যে ব্যাখ্যাই দিন, বিরোধিতার মাত্রা চড়িয়ে এ দিন কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী এমনকী রাষ্ট্রপতিরও কাউকে খুনের অধিকার নেই। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো যখন বলছেন, তাঁর পিসি কিষেণজিকে খুন করেছেন, মমতা কোনও প্রতিবাদও করলেন না! তা হলে মমতার বিরুদ্ধে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলা হবে না কেন?’’ সিপিএমের তরুণ সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ও আক্রমণ করেছেন মমতাকেই। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘কিষেণজির মৃত্যুর পরে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র দশটি প্রশ্ন করেছিলেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার উত্তর দেননি। উত্তর দিলেন তাঁর ভাইপো।’’ কিষেণজির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সেই সময়ে রাজ্যে ‘এনকাউন্টারের রাজনীতি’ ফিরে এসেছিল বলে অভিযোগ তুলেছেন ঋতব্রত। বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য মন্তব্য করেছেন, ‘‘জঙ্গলমহলে পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে কিষেনজিকে ব্যবহার করেছিল তৃণমূল। তার পরে তারাই দেখিয়ে দিয়েছে, কাজের বেলায় কাজী, কাজ ফুরোলেই কিষেনজি!’’
সংঘর্ষেই কিষেনজির মৃত্যু হয়েছিল, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছে নবান্নও। নবান্নের আমলারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন ২০১১-র ২৪ নভেম্বর পশ্চিম মেদিনীপুরের জামবনির বুড়িশোল জঙ্গলে মৃত্যু হয় কিষেনজির। ওই অপারেশনে রাজ্য পুলিশের হয়ে নেতৃত্বে ছিলেন তদানীন্তন ঝাড়গ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন) অলোক রাজোরিয়া। কিষেনজির মৃত্যুর ঘটনার প্রথম এফআইআর-ও করেন রাজোরিয়াই। নবান্ন সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের সুপারিশের ভিত্তিতেই কিষেনজির অপারেশনের জন্য তাঁকে পরে রাষ্ট্রপতি শৌর্য পদকও দেন।
তবে ওই শৌর্য পদক পাওয়া নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, শৌর্য পদক পাওয়ার জন্য রাজ্য সরকার অলোক রাজোরিয়ার হয়ে যে রিপোর্ট পাঠিয়েছিল, তাতে তুমুল সংঘর্ষেরই উল্লেখ করা হয়েছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মাওবাদীদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর সংঘর্ষে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে লড়াই করেন রাজোরিয়া। রাজ্য প্রশাসনের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘রাজ্য সরকারের ওই প্রস্তাব প্রথম দু’বার ফিরিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সরকার ফের তৃতীয় বার পাঠালে তা গৃহীত হয়।’’
এই সংক্রান্ত আরও খবর...
শাল জঙ্গলে মুখ থুবড়ে পড়ে ক্ষতবিক্ষত দেহটা