রিপোর্ট গোয়েন্দা দফতরের

রাজ্যে মাদক পাচারের শীর্ষে মুর্শিদাবাদ

রাজ্যে মাদক পাচারে শীর্ষে রয়েছে মুর্শিদাবাদ। এ বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত রাজ্যের গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি মাসে রাজ্যে নানা অপরাধ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় সিআইডি ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়েবসাইটে।

Advertisement

বিমান হাজরা

রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৪৫
Share:

রাজ্যে মাদক পাচারে শীর্ষে রয়েছে মুর্শিদাবাদ। এ বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত রাজ্যের গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতি মাসে রাজ্যে নানা অপরাধ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় সিআইডি ওয়েস্ট বেঙ্গল ওয়েবসাইটে। জানুয়ারি থেকে জুলাই রিপোর্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গত সাতে মাসে রাজ্য পুলিশ ১৯২টি মাদক পাচার সংক্রান্ত আইনে (এনডিপিএস) মামলা রুজু করেছে। এর মধ্যে ৩৯টি মামলাই হয়েছে মুর্শিদাবাদে। গ্রেফতার হয়েছে ৫৪ জন। এর মধ্যে ২৪টি মাদক মামলায় ২২জন ধরা পড়েছে কেবল লালগোলা থানায়, যার সবগুলি ক্ষেত্রেই উদ্ধার হয়েছে হেরোইন। শুধু তাই নয়, কাটোয়া-সহ রাজ্যের বহু জায়গাতেই মাদক পাচারে ধৃতদের অনেকেই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা।

Advertisement

এই মুহূর্তে বহরমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে মাদক পাচারের মামলায় ১৫ জন মহিলা-সহ যে ৩২৩জন বিচারাধীন বন্দী আটক রয়েছে, তার ৪৫ শতাংশ বাসিন্দাই মুর্শিদাবাদ জেলার। এঁদের অধিকাংশই আবার লালগোলা ও লাগোয়া এলাকার বাসিন্দা।

মুর্শিদাবাদে মাদক কারবার অবশ্য নতুন নয়। জেলা পুলিশের এক কর্তার মতে, বছর আটেক আগেও পোস্ত গাছের রমরমা চাষ ছিল ফরাক্কা, সুতি, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর রানিনগর, জলঙ্গী পর্যন্ত। এই পোস্ত গাছের আঠা দিয়ে মাদক তৈরি হত রঘুনাথগঞ্জ ও লালগোলা থানা লাগোয়া গ্রামগুলিতে রীতিমত কারখানা বানিয়ে। জমির মালিকদের কাছ থেকে চড়া টাকায় এই সব জমি ঠিকা নিত এলাকার দুষ্কৃতীরা। এই চাষ বন্ধে সে সময় পুলিশি তৎপরতা বেড়েছিল যথেষ্ট। কয়েকশো জমি মালিকের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে তাদের গ্রেফতারও করা হয়।

Advertisement

পুলিশের একাংশ জানাচ্ছেন, যে সব দুষ্কৃতীরা পোস্ত চাষ করেছিল তাদের অনেককেই ধরা যায়নি তখন। তারাই এখন মাদক পাচারে নেমেছে। কাঁচা মাল হিসেবে পোস্তর আঠা, পোস্তর খোল ভিনরাজ্য থেকে নিয়ে এসে ব্যবসা জমিয়ে বসেছে রঘুনাথগঞ্জ ও লালগোলা থানা এলাকার গ্রামগুলিতে।

সোমবার ধুলিয়ানের ডাকবাংলো মোড়ে মালদহ থেকে আসা একটি লরি আটক করে সামশেরগঞ্জ থানার পুলিশ। উদ্ধার হয় ১০ কুইন্ট্যাল পোস্তর খোল, দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা মালদহের কালিয়াচকের বাসিন্দা। ফলে মালদহ, ফরাক্কা, মুর্শিদাবাদের কোনও কোনও অংশে পোস্ত চাষ ফের মাথা চাড়া দিচ্ছে, সেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসেই ফরাক্কায় গঙ্গার চরে বিঘের পর বিঘে জমিতে পোস্ত চাষের রমরমা দেখে মাথায় হাত পড়েছিল জেলা প্রশাসনের। শেষ পর্যন্ত মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলা শাসক (ভূমি) অরবিন্দ কুমার মিনার নেতৃত্বে প্রশাসন ও পুলিশের এক বড় বাহিনী ফরাক্কার বিন্দুগ্রাম চরে গিয়ে সেই বেআইনি পোস্ত নষ্ট করেন। পুলিশ ও পঞ্চায়েতের নজর এড়িয়ে ৬০০ বিঘে জমিতে পোস্ত চাষ হল কী ভাবে, তা ভেবে বিস্মিত পুলিশ।

পুলিশি তথ্য বলছে, মাদক পাচারে ধৃতদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরই বয়স ২০-২২ বছর। অনেকে কলেজের ছাত্র। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘কৃষ্ণশাইল গ্রাম থেকে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল দুই ছাত্র । এদের একজন জঙ্গিপুর কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। অন্যজন জঙ্গিপুরের একটি হাইস্কুলের দশম শ্রেণির পড়ুয়া। ৪০০ টাকা পাওয়ার লোভে কাকভোরে তারা মাদক পৌঁছে দিচ্ছিল একজনের কাছে।’’ লালগোলা থানার একটি গ্রাম থেকে হেরোইন-সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তিন স্কুলছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, অবস্থাপন্ন ঘরের তিন ছাত্রই পকেট খরচ জোগাড় করতে মাদক পাচার করছিল। এমন উদাহরণ পুলিশের কাছে অজস্র।

কেন এ ভাবে ছাত্রদের জড়ানো হচ্ছে? জঙ্গিপুর মহকুমা আদালতের সরকারী আইনজীবী সোমনাথ চৌধুরী বলেন, এর পিছনে রয়েছে সচেতন পরিকল্পনা। তিনি জানান, খুনের মামলাতেও ৯০ দিনের পর জামিন মিলতে পারে অভিযুক্তের। কিন্তু মাদক পাচারের মামলায় জামিনের ব্যবস্থা নেই। দেখা গিয়েছে, মাদক পাচারের মূল পান্ডারা কেউই ধরা পড়ে না। যারা ধরা পড়ে, তারা বেশির ভাগই বাহক। তবে অভিযুক্তদের নাবালক হিসেবে দেখানো গেলে তারা জামিন পেতে পারে, সাজার হাত থেকেও বেঁচে যেতে পারে। ‘‘মাদকের কারবারিরা এটা বুঝেছে বলেই ছাত্রদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে।’’

এলাকার বিধায়ক কংগ্রেসের আখরুজ্জামান বলেন, ‘‘পুলিশি ধরপাকড় অবশ্যই থাকবে, পাশাপাশি প্রতিটি স্কুলে, ধর্মস্থানে মাদকের কুফলের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে।’’ এলাকার বাসিন্দা তৃণমূলের শিক্ষাসেলের চেয়ারম্যান সেখ ফুরকান বলেন, ‘‘পাশেই বাংলাদেশ সীমান্ত। নানা ভাবে অর্থের হাতছানিই তরুণদের বিপথগামী করছে। পোস্ত চাষ বন্ধ হলেও তাই মাদকের দাপট বন্ধ হয়নি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন