North Bengal

হিন্দু সহকর্মীর মৃত্যুতে অশৌচ পালন করলেন মুসলিম শিক্ষক

নভেম্বরের শেষে মারা যান বানারঘাট হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক সঞ্জনকুমার বিশ্বাস। তাঁর এই চলে যাওয়া পরিবারের বাইরে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে আসফাককে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:৪৬
Share:

মৃত সঞ্জন কুমার বিশ্বাস ও আসফাক আহমেদ ।—নিজস্ব চিত্র।

হিন্দু সহকর্মীর শেষকৃত্য সারলেন মুসলিম শিক্ষক! হিন্দু রীতি মেনে মাথা ন্যাড়া করলেন। এমনকি, সপরিবারে অশৌচও পালন করলেন ১১ দিন ধরে। ধর্মীয় মেরুকরণের ইস্যু তুলে গোটা দেশ যখন উত্তাল, তখন জলপাইগুড়ির ওই শিক্ষক আসফাক আহমেদ বুঝিয়ে দিলেন সম্পর্কের কোনও ধর্ম হয় না।

Advertisement

নভেম্বরের শেষে মারা যান বানারহাট হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক সঞ্জনকুমার বিশ্বাস। তাঁর এই চলে যাওয়া পরিবারের বাইরে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে আসফাককে। সঞ্জনবাবুকে বন্ধু হিসাবে যেমন ভালবাসতেন তিনি, তেমনই পথ প্রদর্শক, বাবার মতো এবং গুরু হিসাবে শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর চলে যাওয়ায় ভেঙে পড়েন আসফাক। কিন্তু শুধুমাত্র প্রণাম করে, ছবিতে ফুলের মালা পরিয়েই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেননি তিনি। বরং পরম প্রিয় মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাতে অন্য পথ বেছে নেন তিনি। হিন্দু রীতি মেনে মাথা মুড়িয়ে তাঁর শেষকৃত্য সারেন। স্ত্রী এবং ন’বছরের ছেলেকে নিয়ে পালন করেন ১১ দিনের অশৌচ। এমনকি পুরোহিত ডেকে জলঢাকা নদীর ধারে ক্রিয়াকর্মও সম্পন্ন করেন রবিবার। মুর্শিদাবাদের বাড়িতে থাকা তাঁর বাবা-মা এই কাজে কোনও ভাবেই বাধা দেননি।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ক্ষত তখনও দগদগে। সেই রকম একটা সময়ে মুর্শিদাবাদের কান্দি থেকে বানারহাট হাইস্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন আসফাক। সেটা ১৯৯৯ সাল। যে শিক্ষাপ্রাঙ্গন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলে, সেখানেই চরম হেনস্থার শিকার হতে হয় তাঁকে। ইসলাম ধর্মের কাউকে নিজেদের সঙ্গে জুড়ে নিতে চাননি বাকি শিক্ষকরা। ব্যতিক্রম শুধু কর্মশিক্ষার শিক্ষক সঞ্জনকুমার বিশ্বাস। নানা গঞ্জনার মধ্যে তরুণ আসফাককে পুত্রস্নেহে বুকে টেনে নেন তিনি। যত দিন না মাথা গোঁজার জায়গা মিলছে, নিজের বাড়িতে তাঁকে থাকার আমন্ত্রণও জানান। ধর্মের চেয়ে মনুষত্ব্যই যে বড় কথা, সে কথা আসফাককে বোঝান তিনি।

Advertisement

আরও পড়ুন: ফেরার বজরং নেতার দেওয়া তালিকা ধরেই ‘গোহত্যাকারী’দের খুঁজছে যোগীর পুলিশ​

সেটাই সূত্রপাত। তিন কন্যার পিতা সঞ্জনবাবুর ছেলে ছিল না। তাই আসফাক অন্তঃপ্রাণ হয়ে ওঠেন তিনি। এর মধ্যেই নিজের থাকার বন্দোবস্ত করে নেন আসফাক। সঞ্জনের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকা শুরু করেন। কিন্তু, সেই চলে যাওয়াও তাঁদের বন্ধুত্বে কোনও প্রভাব ফেলেনি। এমনকি ২০০৫ সালে সঞ্জনবাবু অবসর নেওয়ার পরেও সেই সম্পর্ক বহাল তবিয়তে ছিল।

আসফাকের কথায়, ‘‘যে বছর চাকরিতে ঢুকি, সে বছর স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী বছর ছিল। ভিন্‌ধর্মী হওয়ায় অনেকেই আমার নিয়োগে আপত্তি তুলেছিলেন। কিন্তু সঞ্জনবাবু ও তাঁর পরিবার বরাবর আমার পাশে থেকেছেন। কু’কথা কানে তুলতে নিষেধ করেছিলেন উনি। নিজের বাড়িতে জায়গাও করে দিয়েছিলেন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ওঁর শেষকৃত্য সারা নিজের দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিল, তাই করেছি। তবে নিছক দায়বদ্ধ ছিলাম বলে নয়, এই সম্মানটুকু ওঁর প্রাপ্য ছিল।’’

আরও পড়ুন: পাঁচ দিনের সিবিআই হেফাজতে অগুস্তা চুক্তিতে অভিযুক্ত দালাল জেমস​

প্রাক্তন সহকর্মীর প্রতি আসফাকের এমন ভক্তি-শ্রদ্ধায় আশ্চর্য হননি স্কুলের অন্য সহকর্মীরাও। বিজ্ঞানের শিক্ষক মুকুল বর্মণ বলেন, ‘‘সঞ্জনবাবু মানুষটাই অমন ছিলেন। অনেককে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি। তবে ওঁর আদর্শ আসফাককেই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে গিয়েছিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন