খাদিজা বানু
২০০৫ সাল। বহরমপুরে ‘কস্তুরবা গাঁধী মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’ মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে সেমিনার করছে। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাকক্ষ জুড়ে শতাধিক বিষণ্ণ মহিলার মুখ। কোলে-কাঁখে শিশু। দু’তিনটি করে শিশু ‘উপহার’ দিয়ে বাড়ি থেকে তাঁদের তাড়িয়ে দিয়েছে স্বামীরা। মুখে শুধু বলে দিয়েছে, ‘তালাক! তালাক! বায়েন তালাক!’’
ব্যস! স্বামীর সঙ্গে, শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে দু’তিন সন্তানের মায়ের সম্পর্ক শেষ। ১০ টাকার ‘নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প পেপার’-এ ‘তালাক দিলাম’ লিখে দেওয়া হয়েছে অনেককে। কেউ আবার ফোনে তালাক পেয়েছেন। এই সব হতভাগ্য মহিলাদের কথা তাঁদের মুখ থেকে শুনে ভিতর থেকে যেন কেঁপে উঠেছিলাম সে দিন।
পরের বছরই কন্যাকুমারী এবং পুণে গাঁধী বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখে এ রকম আরও করুণ মুখ। মনে হল, কিছু একটা করতেই হবে। শুধু বসে থাকলে আর কথা বলে গেলে চলবে না। ২০০৭ সালে বহরমপুরে আমরা গড়ে তুললাম ‘রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি’। কাজ বলতে প্রধানত দু’টি— এক, ছিন্নমূল মহিলাদের স্বনির্ভর করা ও ভারতীয় নারী হিসাবে তাঁদের আইনি সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। দুই, তাঁদের সরকারি অনুদান আদায় করা।
গত কয়েক বছরে আড়াই হাজার মহিলা এসে এই ছাতার তলায় জড়ো হয়েছেন। এঁদের অতিরিক্ত পণের টাকা দিতে পারেনি বলে কেউ তালাক পেয়েছেন। কারও স্বামীর ‘শখ’ একটি করে সন্তান পয়দা করে তালাক দিয়ে পরপর বিয়ে করে যাওয়া। কাউতে আবার মেয়ে হওয়ায় তালাক দেওয়া হয়েছে। শরিয়ত ও মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের দোহাই দিয়ে মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তত লাখখানেক মহিলাকে দুর্বিসহ দশায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
এঁরা সকলেই একই রকম অসহায় বা সম্পন্ন, শিক্ষিত বা নিরক্ষর নন। বেশির ভাগই গরিব ও অল্পশিক্ষিত। মর্জিনা, ফুলিয়া, আকলেমার মতো কম লেখাপড়া জানা মহিলাদের সমিতির কার্যালয়ে সেলাই শেখানো হয়। সঙ্গে শেখানো হয় গান, আঁকা ও লেখাপড়াও। সাগরদিঘির বিলকিস খাতুন আবার শিক্ষিত। তালাক পেয়ে সে অবসাদে ভুগছিল। এক সময়ে আত্মঘাতী হতেও চেয়েছিল। এক সন্তানের মা বিলকিস এখন অসমে এক অসরকারি সংস্থার পদাধিকারী।
তিন তালাক বাতিলের রায় ঐতিহাসিক ঘটনা। আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু মুসলিম মহিলাদের বহু লড়াই বাকি। আরও সংগ্রামের পথ হাঁটতে হবে। আমরা ভারতীয়। তাই আমরা, এ দেশের মুসলিম মহিলারা যে কোনও ভারতীয় নাগরিকের মতো সমানাধিকার চাই। মুসলিম ব্যক্তিগত আইন চাই না। বহুবিবাহ, নিকাহ্ হালালা (যে প্রথায় তালাক দেওয়া স্ত্রীকে বিয়ে দিয়ে ফের তালাক দিইয়ে ফের বিয়ে করা যায়)-র বিলোপ চাই।
লেখক রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক