অক্ষমের পাশে দরদি দারদিস

বেআইনি বহু গাড়ির পিছনে লেখা থাকে—ট্রাফিক আইন মেনে চলুন। কোনও গাড়ির সিটের উপরে ‘প্রতিবন্ধী’ লেখা থাকলেও সেখানে বসে পা দোলান তরতাজা কোনও যুবক। প্রতিবন্ধী কেউ বসতে চাইলে ছিটকে আসে বিদ্রূপ, ‘‘কত শতাংশ? সার্টিফিকেট আছে?’’

Advertisement

সেবাব্রত মুখোপাধ্যায়

বেলডাঙা শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৭ ০২:৫৭
Share:

যাত্রী কোলে দারদিস।—নিজস্ব চিত্র।

চলতি কি নাম গাড়ি!

Advertisement

আর সেই গাড়িতে রোজ যে কত কী ঘটে যায়, সে খবর আর ক’জন রাখেন!

বেআইনি বহু গাড়ির পিছনে লেখা থাকে—ট্রাফিক আইন মেনে চলুন। কোনও গাড়ির সিটের উপরে ‘প্রতিবন্ধী’ লেখা থাকলেও সেখানে বসে পা দোলান তরতাজা কোনও যুবক। প্রতিবন্ধী কেউ বসতে চাইলে ছিটকে আসে বিদ্রূপ, ‘‘কত শতাংশ? সার্টিফিকেট আছে?’’

Advertisement

আর টোটো কিসসা?

ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো শহরে নতুন আসা কোনও যাত্রীর কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া, রাতবিরেতে পর্যটকদের ভুল গন্তব্যে নামিয়ে দেওয়া, ভাড়া দিতে না পারায় গরিব বৃদ্ধার কাছ থেকে ওষুধ কেড়ে নেওয়া— অভিযোগের তালিকা বেশ দীর্ঘ। এমন গাড়ি-যাত্রায় হোঁচট খেতে হয় বেলডাঙায়।

স্টেশনের পাশে দাঁড়ানো টোটোর ভিড়েও নজর কেড়ে নেয় লাল টোটো। গায়ে সাদা কালিতে লেখা— ‘প্রতিবন্ধীদের সিট ফ্রি’।

শহরের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বছর পঞ্চাশের দারদিস হোসেনের এমন কীর্তি দেখে প্রথমে রে রে করে উঠেছিলেন অন্য টোটো চালকেরা। পরে অবশ্য তাঁরা মেনে নিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ‘‘এমন পাগলও যে এই দুনিয়ায় আছে তা দারদিসকে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না।’’

সম্প্রতি পলাশিপাড়া থেকে বেলডাঙায় এসেছিলেন শ্যামসুন্দর মণ্ডল। হাতে ক্রাচ। বেশ কিছুটা পথ হেঁটে তিনি ক্লান্ত। শ্যামসুন্দর জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘ছাপাখানা মোড় যাব। কত ভাড়া?’’ উত্তরে এক টোটো চালক তাঁকে দেখে জানিয়েছিলেন, ‘‘গাড়িতে উঠলেই ১০ টাকা। তবে ওই যে লাল গাড়িটা দেখছেন, ওটাতে উঠে পড়ুন। কোনও ভাড়া লাগবে না।’’

শ্যামসুন্দর হতভম্ব। তখনই হাসিমুখে এগিয়ে আসেন দারদিস, ‘‘আসেন কর্তা। ক্রাচ দু’টো দিন। এই হাতলটা শক্ত করে ধরে উঠে পড়ুন। কোনও ভাড়া লাগবে না। আপনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আপনার সঙ্গে আছি। কোনও চিন্তা নেই।’’ শ্যামসুন্দর জোর করে ভাড়া দিতে গেলেও দারদিস নেননি। দারদিস দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। সাড়ে তিন বছর আগে হার্নিয়ার অস্ত্রোপচারের পরে আর মাঠে কাজ করতে পারছিলেন না। বেশ কিছু দিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল। দারদিস বলছেন, ‘‘তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, সামান্য অস্ত্রোপচারের পরে নিজেকে যদি এমন হয়ে যেতে হয়, তা হলে প্রতিবন্ধীদের কতটা লড়াই করতে হয়। কোনও উপকার নয়, আমি ওঁদের লড়াইয়ে একটু সঙ্গ দিচ্ছি মাত্র।’’

সুস্থ হয়ে ওঠার পরে জমি বিক্রি করে তিনি ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ টোটোটা কেনেন। বাড়িতে স্ত্রী, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে। দারদাসের স্ত্রী তসলিমা বিবি বলেন, ‘‘দিনে গড়ে আড়াইশো টাকা আয় হয়। পরবের সময়ে শ’পাঁচেক টাকা। সংসারে অভাব আছে। কিন্তু ওর এই কাজকেও আমরা সম্মান করি।’’ বেলডাঙা পুরসভার ভাইস চেয়ারম্যান আবু সুফিয়ান মণ্ডল বলেন, ‘‘দারদিসের এই কাজ প্রশংসনীয় তো বটেই, দৃষ্টান্তও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন