আমার দেশ, আমার তেরঙ্গা: লালবাগে। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
বোলপুর, জায়গাটার নাম শুনলেই তাঁর বুকে ঢেঁকি পড়তে শুরু করে। দোতলা বাড়ির সামনে নিচু পাঁচিলের গায়ে সজনে গাছ। আবছা হয়ে আছে একটা গরুর গাড়ি, ব্যাস।
বশির মিঞার বোলপুর ওই সজনের ছায়া আর গরুর গাড়ি।
বাকিটা থমকে আছে চুপি চুপি কলকাতা পাড়ি দেওয়ার এক ভোর রাতে। তখন তাঁর সাড়ে পাঁচ। মাস কয়েক আগে, ডুমো আলোর শহরে রাতজাগা গঞ্জ গাইছে জনগনমন...১৫ অগস্ট। একটু একটু এখনও, তবে ফিকে। আখতারুদ্দিন বশিরের স্বাধীনতা দিবসের যাত্রা শুরু এ ভাবেই। তবে, সে স্বাধীনতা ছায়া দেয়নি। বশির বলছেন, ‘‘তিরাশি হয়ে গেল, দেশ বদলে যায় পতাকার রং-ও স্বাধীনতা পেলাম কি, কে জানে!’’
দেশভাগের পরে যখন মনে হয়েছিল, বোলপুরের গা ঘেঁষা গঞ্জের ঠিকানাটা লাউ মাচার মতোই পাকাপোক্ত থেকে গেল, তখনই রাতের অন্ধকারে ঘোষপাড়া থেকে নিভৃতে এসেছিল শাসানি। পড়শিদের ভরসা সত্ত্বেও বশির মিঞার আব্বাজান খুরশিদ সাহেব ভরসা পাননি। তিন মেয়ে চার ছেলে, স্ত্রী, মা— ভরা পরিবার নিয়ে তাঁদের ধানের গলুই, কই-পুকুর ছেড়ে কলকাতা চলে যেতে হয়েছিল। সেখানে এক আত্মীয়ের আশ্রয়ে মাস কয়েক কাটিয়ে শেষতক সব দ্বিধা ঝেড়ে রাঢ়ের মানুষটা হারিয়ে গিয়েছিলেন ফরিদপুরের পিছল মাঠে।
খুরশিদ আর ফেরেননি। বশির বলছেন, ‘‘১৪ অগস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সবুজ পতাকা তুলেই কেটে গিয়েছিল আমার কৈশোর কালটা। তবে কি জান, মন পড়ে থাকত সেই বোলপুরে।’’
নতুন দেশে যখন একটু একটু করে মানিয়ে নিচ্ছেন, তখনই পূব-পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ। বশির বলছেন, ‘‘সে এক দোটানা গিয়েছে, ঘনঘন খান সেনাদের হানা, ভোরের উঠোনে দাউ দাউ করে জ্বলছে গোলাঘর, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সে দিন বিকেলেই আমার সেজ বোনের লাশ মিলল পুকুরে। অত্যাচারের পরে খান সেনারা ফেলে গিয়েছিল!’’
বাবার গোরে কদম ফুল ছড়িয়ে দিন কয়েক পরে সেই এক ভোরবেলা ফের পলায়ন। পড়ে থাকল বাড়ি, বই-খাতা, বাবার কবর। ছিন্নমূল বশির দাদাদের সঙ্গে দু’রাত ধান খেতে মাড়িয়ে এসে উঠলেন লালগোলায়।
‘‘ফিরতে পেরে খুব যে স্বস্তি পেয়েছিলাম তা নয়, তবে মনে হয়েছিল দেশে ফিরলাম’’, বলছেন বশির। এক দেশ থেকে অন্য দেশ, বাড়ি বদলে যায়, বদলে যায় পরিচয়, স্বাধীনতার দিনক্ষণ। তবু, তাঁর হারানো গ্রাম, সজনে গাছ, গরুর গাড়ি— বশির বলছেন, ‘‘সেই তো এলাম, বোলপুরের কিছুটা কাছাকাছি তো ফিরে এলাম!’’