মগ্ন মেশিনে। নিজস্ব চিত্র
হাত পাততে লজ্জা করে। তাই, আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো ওরা লড়েই বাঁচছেন।
বহরমপুরের আম্বিয়া শেখ, মহব্বত শেখের সঙ্গে তাই এক রেখায় জুড়ে যান কৃষ্ণনগরের অর্চনা পাল। আজ, বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে তাই তাঁরাই অনন্য বিজ্ঞাপন।
ট্রাই সাইকেলে ভর করে বেরিয়ে পড়েন বাদাম বেচতে। চলে যান দূর দূর গাঁয়ে। দিনভর বাদাম বেচে যা আয় হয় তাই দিয়ে দিন গুজরান।
বহরমপুরের সলুয়াডাঙার বছর ছেচল্লিশের আম্বিয়া শেখের দিনযাপন এ ভাবেই। একশো শতাংশই প্রতিবন্ধী। জমি জিরেত আছে খুব সামান্য। চাষে যা ফসল ওঠে তাতে সংসার চলে না। তাই কষ্ট হলেও বেরিয়ে পড়েন বাদাম বেচতে। স্ত্রী লায়লা বিবি আম্বিয়াকে ধরে ট্রাইসাইকেলে বসিয়ে দেন। সাইকেলে তুলে দেন বাদামের বস্তা, দাড়ি-পাল্লা।
কোনও দিন পাঁচ কিলোমিটার দূরে গজধরপাড়া, কোনও ছয় কিলোমিটার দূরে গঙ্গাপুর মোড়ে পৌঁছে যান। বাড়ি ফেরা সেই সন্ধে নামলে। আম্বিয়া বলছেন, “হাত পাততে লজ্জা লাগে। তাই কষ্ট হলেও ট্রাই-সাইকেল নিয়ে বাদাম বিক্রি করতে যাই।” তিনি জানান, বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাদাম বিক্রি করে মেরেকেটে শ’দেড়েক টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে সংসার চলে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ সামলানো।
স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ হিলালউদ্দিন বলছেন, “প্রতিবন্ধী হওয়ায় হাঁটাচলা করতে পারেন না। কিন্তু প্রতিবন্ধিকতাকে তুড়ি মেরে সরিয়ে বাদাম বেচে সংসার চালাচ্ছেন। তাঁর এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাতেই হয়।”
সুতিঘাটার মহব্বত শেখের লড়াইটাও একই রকমই। ৮০ শতাংশই প্রতিবন্ধী। তবুও ট্রাই-সাইকেলে চেপে বেরিয়ে পড়েন আশপাশের গ্রামে। ভাঙাচোরা প্লাস্টিক বদলে নতুন প্লাস্টিকের জিনিসপত্র ফেরি করেন। বছর পয়তাল্লিশের মহব্বতের সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়া দূরে থাক, প্রতিবন্ধী ভাতাটুকু জোটেনি। এক চিলতে টালির ঘরে কোনও মতে মাথা গুঁজে বসবাস। জমি-জায়গা বলতে কিছু নেই। এ ভাবে ব্যবসা করে দিনে ৭০-৮০ টাকা আয় হয়। তা দিয়েই কোনও রকমে সংসার চলে। ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খরচ তো আছেই। মহব্বত বলছেন, “সে সময় লাঠিধরে হাঁটা-চলা করতে পারতাম। কিন্তু বছর পনেরো হল একেবারে হাঁটাচলা করতে পারি না।” কিন্তু সংসারের এই হাল দেখে বসেও থাকতে পারেন না। বাড়ির লোকজন ট্রাই-সাইকেলে তুলে দেন। কোনও দিন সাইকলে চালিয়ে তিন-চার কিলোমাটির দূরে চলে যান। সারগাছি বাজার থেকে মালপত্র কিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করেন। মহব্বতের এই লড়াইকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন স্থানীয়েরা। সারগাছির সাহিল কবির বলছেন, “প্রতিবন্ধিকতাকে কী ভাবে জয় করতে হয়মহব্বত তা দেখিয়ে দিয়েছেন।” মহুলার জয়ন্ত পাল, সুতিঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিমউর রহমানেরা বলছেন, “সুতিঘাটার আশপাশে ১০-১২টি গ্রামে ট্রাইসাইকেলে করে ফেরি করেন। ক্রেতারাই তাঁকে সহায়তা করেন।”
সম্প্রতি জেলা পরিষদের সহকারী সভাধিপতি শাহনাজ বেগম মহব্বতের বাড়ি গিয়েছিলেন। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে একটি বাড়ি করে দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন। শাহনাজ বলছেন, “কেন প্রতিবন্ধি ভাতা পাচ্ছেন না তা খোঁজ নিয়ে দেখব। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে শীঘ্রই তাঁকে একটি বাড়ি করে দেওয়া হবে।”
জন্ম থেকেই তাঁর পায়ে সমস্যা। ক্রাচ ছাড়া এক পা হাঁটতে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়তেন তিনি। কেন তিনি আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নন, তা নিয়ে তাঁর দুঃখ ছিল বিস্তর। কিন্তু, বাবা-মা তাঁকে বোঝান, তিনি নিজের মতো করে সবল। মনের জোড়ে আর পাঁচজনের মতোই হয়ে উঠতে পারেন তিনি। কিন্তু বয়স ২৫ ছাড়াতে না ছাড়াতেই বাবাকে হারাতে হয়েছিল কৃষ্ণনগরের ঘুর্ণির অর্চনা পালের। কারওর গলগ্রহ হয়ে বাঁচবেন না বলে তিনি সেলাই শিখেছিলেন। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু। ৫৬ বছরের অর্চনা এখন স্বাবলম্বী। ভাই প্রশান্তের পরিবারে থাকলেও সেলাই করে যা রোজগার করেন, তা থেকে নিজের খরচ বাঁচিয়ে সঞ্চয়ও করেন। পা দিয়ে সেলাই মেশিন চালাতে পারেন না বলে কিনেছেন যন্ত্রচালিত সেলাই মেশিন। পাড়াল লোকেরা বিভিন্ন প্রয়োজনে এখন তাঁরই দ্বারস্থ হন। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘আর পাঁচটা টেলরের থেকে অর্চনাকে কোনও দিন আলাদা মনে হয়নি।’’