রাতের শহর আদৌ নিরাপদ কতখানি?

রাস্তায় এরা ছাড়া আর কোনও জনমানুষের দেখা নেই। রাস্তা কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের পিছনে হস্টেলের সামনে দিয়ে চলে যায়। জনপ্রাণীহীন রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত নীরবে চলে যায় একটা টোটো। সওয়ার এক জন মাত্র যাত্রী। হেঁটে যান এক জন। নিজের মনে।

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:৫১
Share:

হায়দরাবাদ ধর্ষণ-কাণ্ডের প্রতিবাদে রাস্তায় কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের ছাত্রীরা। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

রাত বাড়ছে। একটু একটু করে শীতের চাদরে নিজেকে মুড়ে নিচ্ছে কৃষ্ণনগর। ঘুমন্ত রাস্তায় তখন কাদের আনাগোনা? রাতের আনাচ-কানাচ ঘুরে দেখে এল আনন্দবাজার।

Advertisement

রাত সাড়ে দশটা

Advertisement

ফোয়ারার মোড় থেকে কলেজ স্ট্রিট হয়ে রাস্তা ঘুরে গিয়েছে বর্ণপরিচয় ভবনের দিকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের হাওয়া শিরশিরে হতে শুরু করেছে। রাস্তা ফাঁকা। শুধু লাইটপোস্টের নীচে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে গোটাচারেক কুকুর। গাড়ির শব্দে তারা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। এক বার আড়চোখে দেখে নেয় অচেনা আগন্তুককে।

না। রাস্তায় এরা ছাড়া আর কোনও জনমানুষের দেখা নেই। রাস্তা কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের পিছনে হস্টেলের সামনে দিয়ে চলে যায়। জনপ্রাণীহীন রাস্তা দিয়ে অত্যন্ত নীরবে চলে যায় একটা টোটো। সওয়ার এক জন মাত্র যাত্রী। হেঁটে যান এক জন। নিজের মনে। শহরের অন্যতম নিঝুম রাস্তা। রাস্তার পাশে ঘন জঙ্গল। বহু মানুষ যাতায়াত করেন এই রাস্তা দিয়ে। আধো-অন্ধকার রাস্তাটা ঠিক কতটা নিরাপদ, বোঝা কঠিন নয়। গা-ছমছম করে।

রাত পৌনে এগারোটা

রাস্তা চলে গিয়েছে হোলি ফ্যামিলি গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে। ডনবস্কো স্কুল হয়ে রাস্তা ক্রমশ এগিয়ে যায়। কোথাও কোনও জনপ্রাণি নেই। নেই কোনও যানবাহনের অনাগোনা। অথচ, এটি শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে দূরপাল্লার বাস থেকে নেমে সকলে এই রাস্তা দিয়েই শহরে ঢোকেন। জনমানবশূন্য রাস্তায় দেখা মেলে শুধু পথচলতি ক’টা কুকুরের। রাস্তা মেশে আরও এক শহরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায়। সেটা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে চলে দিয়েছে শহরের ভিতরে। গৌড়ীয় মঠের সামনে দিয়ে ওঠা গেল ডিএল রায় রোডে। যা চলে গিয়েছে বিপিসিআইটি কলেজের সামনে দিয়ে।

রাত এগারোটা

স্টেশনের দিক থেকে একটা অটো যাত্রী নিয়ে ছুটে যায় নবদ্বীপের দিকে। দু’-চারটে গাড়ি ছুটছে জাতীয় সড়কের দিকে। বাকি রাস্তা ফাঁকা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ধরা পড়ে এক ছায়ামূর্তি। মোবাইলে কথা বলতে বলতে তিনি হেঁটে যান। নির্জন রাস্তায় জনপ্রাণী বলতে তিনি একাই। দীর্ঘ রাস্তাটা কয়েক বছর আগেও ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। ছিনতাইবাজদের প্রায় মুক্তাঞ্চল। এখন পরিস্থিতির অনেকটাই বদলেছে। এই এলাকার সমাজবিরোধীদের বেশির ভাগই এখন শ্রীঘরে। ফলে, আগের মতো ভয় না থাকলেও মোটেও নিরাপদ নয়।

রাত সওয়া এগারোটা

শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বেলডাঙা মোড়। বছর কয়েক আগে ভরা সন্ধ্যায় সকলের সামনে দুষ্কৃতীদের মধ্যে গন্ডগোলে পড়ে গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল এক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রের। অনেকেই বলেন যে এই এলাকায় রাতে ঘোরাফেরা করে সমাজবিরোধী। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দোকান। খোলা আছে একটা মিষ্টির দোকান আর গোটাদুয়েক পান-বিড়ির দোকান। স্টেশনের দিক থেকে ধীর গতিতে শহরের দিকে ছুটে যায় গোটা তিনেক টোটো। কেউ কেউ স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরছেন হেঁটে। সবুজ রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে স্টেশন থেকে বেলডাঙা মোড় হয়ে শহরের দিকে হেঁটে যান এক মহিলা। তাঁর পিছনে এসে দাঁড়ায় একটা সাইকেল। চমকে উঠি! কোন অঘটন ঘটে যাবে না তো? না, তেমন কিছু নয়। মহিলাকে নিতে এসেছেন ওই সাইকেল আরোহী। দু’জনে গল্প করতে করতে হাঁটা লাগান।

রাত সাড়ে এগারোটা

কৃষ্ণনগর স্টেশন যেন শীতঘুমে লেপ মুড়ি দিয়েছে। ওয়েটিং রুমের ভিতরে শুয়ে আছেন ভবঘুরেরা। চাদর মুড়ি দিয়ে ঝিম মেরে আছে কয়েক জন। তাঁরা রাতের ট্রেন ধরবেন। স্টেশনের দু’টো স্টল তখনও খোলা। বাতাসে ভেসে আসছে ডিমভাজার গন্ধ। স্টেশনের এক পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন জনাতিনেক রেলপুলিশ। তাঁদের সামনে দিয়ে হেঁটে যান এক অল্পবয়সী মহিলা। সম্ভবত, স্টেশনই ওই মহিলার স্থায়ী ঠিকানা।

রাত পৌনে বারোটা

স্টেশন থেকে রাস্তা চলে যায় শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের দিকে। বাতাসে ঠান্ডার পরিমাণ বাড়ছে। বাঁক ঘুরতেই দেখা মেলে তিন মহিলার। এক জনের কোলে ছোট্ট বাচ্চা। বোঝা যায়, তাঁরা হাসপাতাল থেকে ফিরছে। ক্লান্ত তাঁদের চলার গতি। হাসপাতাল চত্বর যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। ব্লাড ব্যাঙ্কের সামনে জনাতিনেক লোক। এক পাশে কয়েক জন রোগীর বাড়ির লোক জটলা করছেন। গেটের নিরাপত্তারক্ষীরা সজাগ।

রাত বারোটা

শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে পাঁচমাথার মোড় হয়ে আনন্দময়ীতলা মন্দিরের সামনে দিয়ে এগোলে রাজা রোড। নিঝুম রাস্তা। একে একে রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর আলো নিভে যেতে থাকে। নির্জন রাজা রোড হয়ে রাজার দিঘির পাশ দিয়ে সোজা জেলা সদর হাসপাতাল। নেদেরপাড়ার মোড়ে বেশ কয়েক জনের দেখা মেলে। ত্রিকোণ পার্কের ভিতরে ক্যারাম খেলতে দেখা যায় জনা কয়েক যুবককে।

রাত সওয়া বারোটা

একেবারেই ভিন্ন ছবি জেলা সদর হাসপাতালের ভিতরে। হাসপাতাল চত্বরে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় প্রসূতিদের বাড়ির লোকজনদের। এখানে সারা রাত খোলা থাকে চা আর পান-বিড়ির দোকান। সকলে ক্লান্ত। কিন্তু ব্যস্ততা জেগে আছে সারা রাত।

রাত সাড়ে বারোটা

আবার পোস্ট অফিস মোড়। জনা কয়েক যুবক সেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। ফাঁকা, সুনসান রাস্তা। শীতের শহরের মতোই ঘুমিয়ে পড়েছে রাস্তার কোলাহল।

গোটা সময়টার শহরে কোথাও পুলিশের দেখা মিলল না। দেখা পাওয়া গেল না পুলিশের কোনও টহলদারি গাড়িরও। রাতের অন্ধকার গাঢ় হতে থাকে ক্রমশ। আঁকড়ে ধরে নিরাপত্তাহীনতা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন