আবার কোথায় যাব বলুন তো?

নানা জায়গায় ঠোক্কর খেতে-খেতে ঠাঁই হয়েছিল ‘রিফিউজি ক্যাম্প’-এ। 

Advertisement

সুস্মিত হালদার

ধুবুলিয়া শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০২:৪৩
Share:

ধুবুলিয়ায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

ক’দিন ধরে একটা শব্দই ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু কলোনিতে— ‘আবার?’

Advertisement

সেই ছোটবেলায় সব হারিয়ে বাপ-মায়ের হাত ধরে, এক কাপড়ে সীমান্ত পেরিয়ে ওঁরা চলে এসেছিলেন এ পারে। নানা জায়গায় ঠোক্কর খেতে-খেতে ঠাঁই হয়েছিল ‘রিফিউজি ক্যাম্প’-এ।

এখানেই বিয়ে। সন্তানদের বড় করা। বার্ধক্যে পৌঁছে এখানেই শেষ দিন অবধি বেঁচে থাকার ইচ্ছে। কিন্তু তা কি আর সম্ভব হবে? সেই সংশয়েই এখন ভুগছেন বছর পঁচাশির শশধর বিশ্বাস।

Advertisement

ধুবুলিয়া আট নম্বর কলোনির ভিতরে ছোট্ট মুদির দোকান শশধরের। কাঠের বেঞ্চে বসে মন দিয়ে কাগজ পড়ছিলেন। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তবু খুঁটিয়ে পড়ছেন অসমে নাগরিকত্ব বিতর্কের খবর। প্রসঙ্গ তুলতেই খেপে যান— “যা খুশি বললেই হল! নাগরিকত্বের প্রমাণ আছে।”

১৯৪৯। শশধরের বয়স তখন সতেরো। বাবা, মা, ভাইবোনের হাত ধরে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে এ দেশে ঢুকতে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। সঙ্গের বোঁচকায় ছিল মাত্র আড়াই কেজি চাল। সেটাই অপরাধ। ধরা পড়ে বাংলাদেশে জেল খাটতে হয়েছে এক বছর সাত মাস। তার পর ভারতে ঢুকে চলে আসেন ধুবুলিয়ার উদ্বাস্তু কলোনিতে। সেখানেই দেখা পান মাঝপথে হারানো পরিবারের।

তবে বেশি দিন থাকা হয়নি একসঙ্গে। বাবা মারা গিয়েছেন। মা চার ভাইবোনকে নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশে রামপুর পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এক পরিবারের পাঁচ জনের বেশি ডোল পাওয়ার নিয়ম ছিল না। তাই থেকে যান তিনি। আজও মায়ের মুখটা বড় জলছবির মতো মনে পড়ে।

আজ যখন আবার নতুন করে তৈরি ঘনাচ্ছে অস্তিত্বের সঙ্কট, যখন ছিন্নমূল হয়ে এ দেশে চলে আসা মানুষদের একাংশ আবার উচ্ছিন্ন হওয়ার ভয় পাচ্ছেন, শশধর বলছেন— “কেন যাব? এই নাগরিকত্ব তো সরকারই আমাদের দিয়েছে।” পাশে বসা বছর ষাটের ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “কাকা, সে কথা শুনছে কে? অসমে ৩০ বছর সেনার চাকরি করা লোককেও তো বলছে ভারতীয় নন!”

মায়ের কোলে চেপে এ পারে চলে এসেছিলেন মাস ছয়েকের ধীরেন্দ্রনাথ। অনিশ্চয়তা, অনাহার, দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে ওঠা মানুষটি জানেন দেশ না থাকার যন্ত্রণা। শূন্য চোখে বলেন, “ভয় লাগছে। আবার নতুন করে ছিন্নমূল হতে হবে না তো?”

১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে ধুবুলিয়ায় তৈরি হয় ২৫টি উদ্বাস্তু ক্যাম্প। ছোট-ছোট খুপরি ঘর এখনও আধো-অন্ধকার। খসে পড়ছে টালি। দেওয়াল জোড়া শ্যাওলা। তবু তো নিজের! এ সব ছেড়ে আবার কি অনিশ্চিতের দিকে যেতে হবে?

আতঙ্ক। সংশয়। অবিশ্বাস।

বছর সত্তরের অঞ্জলি রায়, আয়না বাইনেরা ভাবছেন, এখানে তাঁরা ভোট দেন। রেশন কার্ড আছে। আধার কার্ড আছে। আর, চাইলেই কি বাংলাদেশে তাঁদের ফিরিয়ে নেবে?

ফেরার আগে চোয়াল শক্ত করে অঞ্জলি শুধু জানতে চান, “আবার কোথায় যাব বলুন তো? আমাদের কি কোনও দেশ নেই?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন