মধু দিন-১

প্রতি দিন তিনি দেবতা, এক দিন শুধু প্রিয়

কৃষ্ণ-রাধার দোল উৎসব সারা ভারতেই বসন্তের উদযাপন বলে বিখ্যাত। নবদ্বীপে তা মহাপ্রভুর জন্মতিথি। মহাপ্রভুই পরে কৃষ্ণকে স্মরণ করে গঙ্গার ধারে টেনে এনেছিলেন যমুনা পাড়ের উৎসবকে। যে আয়োজনে রচিত হয় সাহিত্যের নতুন দর্শন।দোলের দিন নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের উৎসব বড় মায়াময়। প্রতিদিন তিনি দেবতা। কেবল একদিন তিনি প্রিয়। সারা বছর তিনি আপামর ভক্তের ধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, ‘রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু’ শ্রীচৈতন্য। কিন্তু ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিনে তিনি সে সব কিছুই নন।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০১:৫৩
Share:

দোলের দিন নবদ্বীপের মহাপ্রভু মন্দিরের উৎসব বড় মায়াময়। প্রতিদিন তিনি দেবতা। কেবল একদিন তিনি প্রিয়। সারা বছর তিনি আপামর ভক্তের ধামেশ্বর গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু, ‘রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু’ শ্রীচৈতন্য। কিন্তু ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিনে তিনি সে সব কিছুই নন। জগন্নাথ পত্নী শচীর কোল আলো করা সদ্যজাত শিশু নিমাই। পরনে লাল চেলি, হাতে চুষিকাঠি। চারপাশে ছড়ানো ঝিনুক-বাটি, ঝুমঝুমি। ভক্তিতে নয়, সেদিন অপত্য স্নেহে সিক্ত তিনি।

Advertisement

পণ্ডিতেরা বলেন, ১৪৮৬ সালের দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় জন্ম নিলেন গোরাচাঁদ। সেই স্মৃতিকে স্মরণে রাখতে বৈষ্ণবসমাজ দোল পূর্ণিমাকে বদলে দিলেন গৌরপূর্ণিমায়। চৈতন্যজন্মের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর পরেও চৈতন্যধামে দোলের দিন তাই শুধুই মহাপ্রভুর আবির্ভাব উৎসব। মহাপ্রভুর মন্দিরে, জন্মস্থানে এদিন আবির কুমকুম নয়, প্রস্তুত থাকে সুগন্ধি অভিষেক বারি, পঞ্চামৃত। দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় আকাশে চাঁদ উঠলেই বেজে ওঠে শতেক শাঁখ, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, মন্দিরা। শুরু হয়ে যায় মহাভিষেক। চৈতন্য বিগ্রহের প্রতীক হিসেবে জগন্নাথ মিশ্রের গৃহে পূজিত ‘রাজরাজেশ্বর’ শিলাকে ১০৮ ঘড়া জলে স্নান করানোর পর ষোড়শোপচারে হয় অভিষেক বা অন্য ‘জাতকর্ম’। গৌরাঙ্গদেবকে পরানো হয় শিশুর চেলি। সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কীর্তন থেকে আরতির সুর। নাটমন্দিরের নহবত খানার সানাই আলাপ জমায় বসন্ত রাগে। রাত যত গড়ায় নাটমন্দিরের হোরিকীর্তনের লয় ততই ঘন হয়ে আসে।

পরদিন অন্নপ্রাশন। ফুলমালায় সাজানো দক্ষিণদুয়ারি সিংহদরজার উপরে নহবতখানা। সানাইয়ে ‘বৃন্দাবনী সারং’। রাগের আলাপের রেশ ধরে উৎসবের সুর ছড়িয়ে পড়েছে মহাপ্রভু পাড়ার ঘরে ঘরে। নাটমন্দিরে উত্তরমুখী গরুড় স্তম্ভের নীচে পদাবলী কীর্তনের সুর। আর গর্ভমন্দিরের বন্ধ দরজার সামনে জড়ো হওয়া হাজার হাজার ভক্ত কন্ঠ মিলিয়ে গাইছেন, “জয় শচীনন্দন জয় গৌরহরি। বিষ্ণুপ্রিয়া প্রাণনাথ নদিয়াবিহারী।”

Advertisement

লালচেলিতে শিশু সাজে ধামেশ্বর মহাপ্রভুর দুর্লভ দর্শনে ভক্তেরা আসেন শিশুর খেলনা নিয়ে। খাদ্য তালিকায়, তরকারি থেকে মিষ্টি সবই ৫৬ রকম করে। রূপোর থালা বাটি গ্লাসে থরে থরে সাজানো সে সব। প্রায় দু’কুইন্ট্যাল অন্ন চূড়ো করে সাজানো। চারপাশে ভিড় করে আছেন হাজারো মানুষ। খাদ্যের সুঘ্রাণ, ধূপের সুগন্ধের সঙ্গে মিশে গেছে আরতির কীর্তনের সুর।

নব বসন্তে মহাপ্রভুর আরতির পদ “ভালি গোরাচাঁদের আরতি বাণী’ সুর বদলে গাওয়া হচ্ছে বসন্ত রাগে। তিনি এলেই তো বসন্ত আসে।

কস্তূরী-চন্দন-অগুরু-ধূপের গন্ধে ম’ম’ করছে নাটমন্দির। সাদা পর্দা দিয়ে ঘেরা নাটমন্দিরের প্রশস্ত চত্বরে একে একে সাজানো হচ্ছে ছাপ্পান্ন ভোগ। নামে ছাপ্পান্ন ভোগ হলেও অন্ন, পরমান্ন, পুষ্পান্ন, মিষ্টান্ন, তরি- তরকারি,ভাজা, পুরি, নিমকি, চাটনি সব মিলিয়ে পদের সংখ্যা কয়েকশো। আর হবে নাই বা কেন? স্বয়ং চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন বলে কথা। তাই এই রাজসূয় আয়োজন নবদ্বীপের মহাপ্রভু বাড়িতে। এই মন্দিরেই বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী সেবিত মহাপ্রভুর শ্রীবিগ্রহের সেবা পুজো হয়ে আসছে কয়েকশো বছর ধরে। একমাত্র এই মন্দিরেই মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশন উৎসব পালন করে থাকেন সেবাইত গোস্বামীরা। তাঁরাই বহন করে চলেছেন বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর উত্তরাধিকার। পুরুষানুক্রমে গোস্বামীরা এই উৎসব পালন করে আসছেন।

তবে বহু প্রাচীন এই অন্নপ্রাশন উৎসবের শুরু ঠিক কবে থেকে, তা নিয়ে কোন পাথুরে প্রমাণ নেই। যেমন জানা যায় না, কী ভাবে নবদ্বীপে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব তিথি আন্তর্জাতিক উৎসবে বদলে গেল। ইতিহাস বলে, প্রধানত পশ্চিম ভারতের উৎসব ‘হোলি’ বঙ্গদেশে এসেছিল সেন রাজাদের আমলে। আদতে পশ্চিমী দোল বা হোলি ছিল বিষ্ণুকেন্দ্রিক উৎসব। কিন্তু গীতগোবিন্দের কবি জয়দেবের হাত ধরে তাতে শ্রীকৃষ্ণের প্রবেশ। তারপর থেকে ধীরে ধীরে হোলি রূপান্তরিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণের দোলে। পরবর্তীতে চৈতন্যদেব দোলকে নতুন ভাবে সাজালেন। নৃত্য, গীত, কীর্তন, পদযাত্রায় উৎসবের ছোঁয়া লাগল দোলে। আবির, কুমকুমে দোল হয়ে উঠল রঙের উৎসব। ১৮ শতকের শেষ এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দোল হয়ে উঠল সেকালের বড়লোকদের উৎসব। উদ্দাম আমোদে তাঁরা দোলে মেতে উঠতেন। ইংরেজদের পলাশি জয়ের পর নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অত্যন্ত ক্ষমতাবান হয়ে উঠলেন। তিনি একের পর এক উৎসব প্রচলন করলেন বঙ্গদেশে। কিন্তু চৈতন্যবিরোধী কৃষ্ণচন্দ্র সে ভাবে দোলকে গুরুত্ব দিলেন না। বরং পৃথক ভাবে প্রচলন করলেন বারোদোলের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্য অনুরাগী বৈষ্ণব ভক্তদের তৎপরতা এবং উদ্যোগে দোল পূর্ণিমা তিথিতে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব উৎসব পালনের ঝোঁক বাড়ল। দোলপূর্ণিমা হয়ে উঠল গৌরপূর্ণিমা।

গত শতকের সাতের দশক এই চৈতন্যকেন্দ্রিক দোল উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। নবদ্বীপের গঙ্গার পূর্ব পাড়ে মায়াপুরে গড়ে উঠল সাগর পাড়ের বিদেশি বৈষ্ণব ভক্তদের মঠ। বিদেশিদের বিপুল অর্থ এবং নিখুঁত পরিকল্পনায় পঞ্চাশ বছরেরও কম সময়ে মায়াপুর নবদ্বীপের দোল তথা চৈতন্যদেবের আবির্ভাব উৎসবকে আন্তর্জাতিক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।

তবে মহাপ্রভু বাড়ীর উৎসবে আড়ম্বরের ছোঁয়া লাগে একশো বছর আগে শচীনন্দন গোস্বামীর সময়ে। মহাপ্রভুর সেবাইত গোস্বামীদের মতে অন্নপ্রাশনের দিন তিনি আর যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নন। তিনি ওই দিন জগন্নাথ মিশ্র ও শচীদেবীর কোল আলো করা আদরের ধন নিমাই বা বিশ্বম্ভর। আর তাই নিমাইয়ের অন্নপ্রাশনে ঝিনুক-বাটি থেকে ঝুমঝুমি, চুষিকাঠি থেকে খেলনা বাদ থাকে না কিছুই। চৈতন্যদেবের জীবৎকালেই বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী বংশীবদন ঠাকুরের সহায়তায় নবদ্বীপে নিজগৃহে নির্মাণ করিয়ে ছিলেন এই বিগ্রহ। অনিন্দ্য সুন্দর এই বিগ্রহকে সেদিন পড়ানো হয় লাল চেলি, পায়ে মল।

এই অন্নপ্রাশন উৎসবের আর এক নাম “জগন্নাথ উৎসব”।

গোস্বামীরা জানান তাঁরা ছাড়া ভু-ভারতে আর কেউ মহাপ্রভুকে অন্নপ্রাশন দেওয়ার অধিকারী নন। থরে থরে সাজানো ভোগের আগে মহাপ্রভুর নামকরণ, চূড়াকরন সবই হয়। তবে প্রতীকী ভাবে। দাদামশাই নাম রেখেছিলেন বিশ্বম্ভর। এদিনও প্রতীকী নামকরন করা হয়। তারপর ভোগ নিবেদন। অন্নপ্রাশনের দিনে মহাপ্রভুকে অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করা হয় মহামূল্য পাত্রে। রূপো, তামা, কাঁসা এবং পেতল এই চার ধরনের পাত্রে সাজানো হয় পদগুলি। রূপোর চারটি করে থালা, বাটি, রেকাবি এবং গ্লাসে নিবেদন করা হয় অন্নব্যঞ্জন। হাত ধোয়ার ডাবর, গাড়ু, ধূপদানি, কোষাকুষি সবই এদিন রূপোর। আর ঝুমঝুমি, চুষিকাঠি, মল—এ সব সোনার।

মহাপ্রভুর অন্নপ্রাশনের মেনুতে থাকে হাজারো পদ। তরকারি, ডাল, শুক্তো, ভাজা, পোস্ত, শাক এবং চাটনি থাকবে সাত রকমের। সঙ্গে মহাপ্রভুর প্রিয় থোড়, মোচা, কচুর শাক, বেগুনপাতুরী, ছানার রসা (ডালনা), ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো থাকবেই। পোস্ত দিয়ে যত রকমের পদ সম্ভব, এমন কি ছানার পোস্ত। কুল, তেঁতুল,আম, আমড়ার টক। তবে মহাপ্রভুর ভোগে নিষিদ্ধ টম্যাটো, পুঁইশাক এবং মুসুরডাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন