—নিজস্ব চিত্র
গাড়ি অন্ত প্রাণ ছেলেটার। কিন্তু গাড়ি চড়ানো দূরে থাক দিনমজুর বাবা-র খেলনাগাড়ি কিনে দেওয়ার ক্ষমতাও নেই। গ্রামে কালেভদ্রে বড় গাড়ি ঢোকে। কোনও কাজে বাবা-র সঙ্গে সদরে গেলে মুগ্ধ হয়ে গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ভোটের দিন সেই গাড়ির টানে স্থবির হয়েই দুষ্কৃতীদের গুলি খেতে হয়েছে তেরো বছরের সারওয়ার মালিথা-কে। বাঁ পায়ের হাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে গিয়েছে গুলি। রোগা ডিগডিগে কিশোর ঘটনার আকস্মিকতায়, আতঙ্কে, পায়ের যন্ত্রণায় প্রায় ঘোরের মধ্যে রয়েছে। ভাল করে কথাও বলতে পারছে না।
নওদা পাটিকাবাড়ি কোনওকালেই ভোট-সন্ত্রাসের জন্য খুব একটা কুখ্যাত ছিল না। বরং ভোট মানেই গ্রামে দিন কয়েক বেশ একটা উৎসব-উৎসব ভাব। সেই চরিত্র বদলে গিয়েছিল শুক্রবার থেকেই। চাপা উদ্বেগ, আশঙ্কা জমাট বেঁধেছিল। ভোটের দিন সকাল থেকেই চারপাশের অঞ্চল থেকে বুথ দখলের খবর আসছিল। তাতে রাজনীতির কারবারিদের মাথাব্যথা হলেও গ্রামের বাচ্চাদের তা স্পর্শ করেনি। তাদের স্কুল ছুটি। বড়রাও ভোট নিয়ে ব্যস্ত, কেউ পড়তে বসার তাড়া দিচ্ছিলেন না। ফলে সকাল থেকেই দিব্যি খেলা শুরু হয়েছিল। সেই দলে ছিল পাটিকাবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সারওয়ার-ও।
বাড়ির দুয়ারে পাটিকাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বুথ হয়েছে। সেখানে আইসক্রিমওয়ালা এসেছেন। মায়ের কাছে আইসক্রিম কেনার বায়না করে সারওয়ার। যেতে দিতে চাননি পারমিনা খাতুন। বুথে ক্রমশ দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে উত্তেজনা বারছিল। বুথ দখল করতে বাইরে থেকে দুষ্কৃতী বাহিনী আসতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছিল। বিপদের আশঙ্কায় ছেলেকে বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু ছেলেও নাছোড়। জোরজার করে মায়ের থেকে ৫ টাকা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল আইসক্রিম কিনতে। হাতে কমলা রঙের আইসক্রিম ধরে ফিরবে, ঠিক তখনই হুশহুশ করে পাচ-ছ’খানা বিশাল বিশাল গাড়ি এসে দাঁড়াল বুথের সামনে। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নামল প্রচুর লোক। আশপাশে সবাই পালাতে লাগল। কিন্তু চোখের সামনে অত বড়-বড় গাড়ি দেখে পা আটকে দিয়েছিল সারওয়ারের। ঠিক তখনই পায়ে প্রচণ্ড একটা ব্যথা শরীর অবশ করে দিল! চোখ অন্ধকার হয়ে গেল।
দুষ্কৃতীদের ছোড়া গুলিতে বুথের সামনেই খুন হয়েছিলেন পাটিকাবাড়ির পঞ্চায়েত সমিতির বিক্ষুব্ধ তৃণমূল সমর্থিত নির্দল প্রার্থী বিলকিস খাতুনের সহযোগী বছর সাতাশের শাহিন শেখ। তাঁর বুক ফুঁড়ে আসা গুলি ঢুকে যায় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সারওয়ারের বাঁ পায়ে। আইসক্রিম ছিটকে যায় হাত থেকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কিশোর। ওই অবস্থায় তার এক দাদা আসিফ হোসেন তাকে কোলে তুলে ছোটে আমতলা গ্রামীণ হাসপাতালে। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ছেলের মাথার কাছে বসে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছিলেন বাবা গোলাম মালিথা। সেই দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ গলায় ছেলে বলে, ‘‘একসঙ্গে এত বড় বড় গাড়ি দেখিনি। অবাক হয়ে যাই। তখনই পায়ে খুব লাগল, আইসক্রিমটায় কামড়ও দিতে পারিনি। হাত থেকে পড়ে গেল। মা-র কথা শুনলে কিছু হত না বোধহয়।’’