তক্কে তক্কে রয়েছে তস্কর!
তাই সতর্ক থেকেও বিশেষ লাভ হচ্ছে না। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই হাওয়া হয়ে যাচ্ছে সাধের মোটরবাইক। গত তিন সপ্তাহে সুতির অরঙ্গাবাদে চুরি হয়েছে ৯টি বাইক।
বাইক মালিকদের তালিকায় যেমন রয়েছেন চায়ের দোকানদার, ব্যবসায়ী, শিক্ষক। তেমনি রয়েছেন সিভিক ভলেন্টিয়ারও! থানার পাশ থেকে বাইক হারিয়ে সুতির সেই সিভিক ভলেন্টিয়ারের আক্ষেপ, ‘‘কী দিনকাল পড়ল বলুন তো? বাইকটা রেখে কিছুক্ষণের জন্য ভিতরে ঢুকেছি। ফিরে এসে দেখি গায়েব! হতচ্ছাড়া ঠিক পিছু নিয়েছিল।’’
পিছু নিয়েছে পুলিশও। সন্দেহভাজন কাউকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে দেখলে তাকে ‘ফলো’ করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও বিশেষ সুবিধা হচ্ছে না। সুতি রীতিমতো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বাজার-হাট, চায়ের দোকান, বিড়ি কারখানা মিলিয়ে দিনভর বেশ জমজমাট থাকে সীমান্ত ঘেঁষা ওই জনপদ। এহেন এলাকায় হঠাৎ করে বাইক চুরি বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন এলাকার বাসিন্দা থেকে পুলিশ সকলেই।
দিন কয়েক আগের এক বিকেলে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশে ধলার মোড়ে মোটরবাইক রেখে খেতের ফসল দেখতে গিয়েছিলেন সামশুল ইসলাম। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখেন বাইক নেই। অরঙ্গাবাদের বাসিন্দা সামশুল বলছেন, ‘‘এ ভাবে বাইক লক করে কতদিন মাঠে গিয়েছি। কিন্তু এমন কাণ্ড এই প্রথম বার ঘটল। থানাতে জানিয়েছি বটে। কিন্তু সে বাইক কি আর ফিরে পাব?’’
অরঙ্গাবাদের ব্যাঙডুবির মোড়েও একই ঘটনা ঘটেছে। বিকেল তিনটে নাগাদ মসজিদের সামনে বাইক রেখে নমাজ পড়তে ঢুকেছিলেন রহমান শেখ। মিনিট দশেক পরে ফিরে এসে দেখেন বাইক উধাও। তন্নতন্ন করে গোটা এলাকা খুঁজেও তিনি বাইকের সন্ধান পাননি। ক্ষুব্ধ রহমান বলছেন, ‘‘অরঙ্গাবাদ তো এমন ছিল না। বাইক, সাইকেল নিশ্চিন্তে রেখে চলাফেরা করা যেত। কিন্তু এখন যে ভাবে চোরের দৌরাত্ম্য বেড়েছে তাতে তো পথে বেরনোই মুশকিল।’’
কিন্তু সীমান্ত ঘেঁষা এই এলাকায় হঠাৎ করে এমন বাইক চুরি শুরু হল কেন?
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে খবর, গত কয়েক মাস থেকে এই এলাকায় শুরু হয়েছে ‘বেটিং’। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, এটা তাস কিংবা অন্য কিছু দিয়ে জুয়া খেলা নয়। এ হচ্ছে আসলে বাজি। যেটা শুরু হয়েছে আইপিএল ও বিধানসভা ভোটের আগে থেকে। তাঁর কথায়, ‘‘ভোটে জিতে কে সরকার গড়বে থেকে শুরু করে আইপিএলে কে জিতবে— এ সব নিয়েই বাজি ধরা হচ্ছে। টাকার অঙ্কটাও কম করে দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আর এই বেটিং-এ হেরে গিয়েই পয়সার জন্য এমন চুরি বাড়ছে বলেই মনে হচ্ছে।’’
বিষয়টি কবুল করছেন সুতি ২ ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি আলফাজুদ্দিন বিশ্বাসও। তাঁর কথায়, ‘‘নির্বাচনে জয়-পরাজয়, আইপিএল নিয়ে বাজি ধরে এলাকায় মোটা টাকার লেনদেন চলছে। সবটাই চলছে অবাধে। বাইক চুরির পিছনে এ সবই অন্যতম কারণ।” পাশাপাশি রয়েছে মদ ও হেরোইনের কারবারও। এলাকার অনেকেই সেই নেশায় আসক্ত। তা নিয়ে বাড়িতে যেমন অশান্তি রয়েছে। তেমনি মাদকের টাকার জন্যও চুরি হচ্ছে বলেও মনে করছে জেলা পুলিশের একাংশ।
পুলিশের অনুমান, বাইক চুরির পরে তা বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। এলাকার কোনও গোপন ডেরায় বাইকের যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। তবে এর পিছনে বড় কোনও চক্র রয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর বলছেন, ‘‘বিষয়টি আমার কানেও এসেছে। বাইক চুরি রুখতে শুধু সুতিতেই নয়, জেলার সর্বত্রই নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সুতি থানাকেও বলা হয়েছে কড়া পদক্ষেপ করতে।’’
সম্প্রতি রঘুনাথগঞ্জে চুরি গিয়েছিল অন্তত ৩৭টি মোটরবাইক। সবথেকে বেশি বাইক চুরি হয়েছিল জঙ্গিপুর হাসপাতাল চত্বর থেকে। হাসপাতালে যাঁরা আসেন তাঁরা সকলেই উদ্বিগ্ন থাকেন পরিজনের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়ে বাইক চুরি করত দুষ্কৃতীরা। সেই বাইক চুরি রুখতে মুফতে গ্যারাজ খুলেছিল রঘুনাথগঞ্জের পুলিশ। ফলও মিলেছিল।
অরঙ্গাবাদে অবশ্য পুলিশ এখনও সে পথে হাঁটেনি। তবে বাইক চোর ধরতে গ্রামে গ্রামে নজরদারি ও তল্লাশি শুরু করেছে সুতি থানার পুলিশ। জগতাই ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান যাদব সিংহ বলছেন, ‘‘কী বলব মশাই, দিনকয়েক আগে আমার নিজের বাইকটাও তো গেল। অরঙ্গাবাদে বাইক চুরির এত রমরমা ছিল না। পুলিশ যতদিন এলাকায় মদ-জুয়ার ঠেক ভাঙতে না পারবে ততদিন এই চুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।’’
তা যতদিন না হচ্ছে ততদিন বাইক চোখে চোখে রাখা ছাড়া আর উপায় কী!