Quack Doctor

হাড় জুড়ছে দৈববাণীতে!

এক কবিরাজ আকবর শেখ জোর গলায় দাবি করলেন, ‘‘গাছের শিকড়ের অনেক শক্তি। শিকড় দিয়ে হাড় জোড়া লাগাই। সঙ্গে দৈবপ্রদত্ত শক্তি তো রয়েছে।’’

Advertisement

মনিরুল শেখ

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৮ ০০:৫৪
Share:

বিতর্ক যে ‘কবিরাজ ঘর’কে ঘিরে। ইনসেটে, হোর্ডিং। নিজস্ব চিত্র

প্লাস্টার নয়, অস্ত্রোপচার নয়, তাঁদের আছে দৈববাণী! তাতেই ভাঙা হাড় পটাপট জুড়ে যায়! অন্তত তাঁদের দাবি সে রকমই!

Advertisement

সাইনবোর্ড-পোস্টার লাগিয়ে, লিফলেট বিলি করে আত্মপ্রচারেও ঘাটতি নেই এই স্বঘোষিত কবিরাজদের। রাস্তার ধারে, বাজারের পোস্টে, বাস বা রেলের দেওয়ালে ঢালাও বিজ্ঞাপন দেন। দৈবশক্তি আর তাঁদের হাতের গুণে নাকি দিব্যি ভাঙা হাড় জোড়া লেগে যায়! রোগীও জুটে যায় বিস্তর। কেস-প্রতি চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ভিজিট! পুলিশ-প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দফতরের নাকের ডগায় বসে কয়েক প্রজন্ম এই ভাবেই করেকম্মে খাচ্ছেন একশ্রেণির মানুষ। নদিয়া বেশ কয়েকটি গ্রামের ঘরে-ঘরে এমন দৈববাণীপ্রাপ্ত বৈদ্যদের ভরভরন্ত পসার। বিজ্ঞাপনের মোহে তাঁদের কাছে গিয়ে চিকিৎসা বিভ্রাটে বিপদে পড়া লোকের সংখ্যাও কম নয়। তার পরেও এ হেন বেআইনি হাড়-জোড়ার কর্মকাণ্ডে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি।

এঁরা মোটেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসক নন, আয়ুর্বেদের সরকার স্বীকৃত-প্রশিক্ষণও এঁদের নেই। বরং এঁরা হাতুড়ে চিকিৎসকদের এমন একটি অংশ যাঁরা বংশপরম্পরায় একটি বিশেষ শারীরিক সমস্যার চিকিৎসা করে আসছেন।

Advertisement

বহু বছর আগে হাড়-জোড়ার কাজ শুরু ধুবুলিয়া থানার খাজুরি গ্রামে। লোকমুখে প্রচলিত গল্প হল, খাজুরির খয়বর হালসানা নামে এক বাসিন্দা একদিন ঘুম থেকে উঠে আচমকা দাবি করেন, তিনি নাকি দৈবশক্তি লাভ করেছেন! এর ফলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি মানুষের শরীরের যে কোনও ভাঙা হাড় জোড়া লাগাতে পারবেন, একটুও এ দিক ওদিক হবে না। স্বপ্নের কথা লিখে তখনই তৈরি করে ফেলেন সাইনবোর্ড। শুরু হয় রোগী দেখা। এখন সেই কাজ করেন তাঁর ছেলে রমজান। তাঁরও পসার রয়েছে দিব্যি। পাঁচ হাজারের কমে কোনও ‘কেস’ হাতে নান না। বিভিন্ন জেলায় কিছু দিন পর পরই চিকিৎসার জন্য ডাক পড়ে।

শুধু এক খাজুরি গ্রামেই এখন এমন হাড় জুড়ে দেওয়া কবিরাজের সংখ্যা অন্তত ১৫। আশপাশের নেকি, ঘাটেশ্বর এমনকি নাকাশিপাড়া থানা এলাকাতেও এমন কবিরাজ গিজগিজ করছেন! ওই এলাকারই পরিচয় হয়ে গিয়েছে হা়ড়-জোড়া গ্রাম নামে। নেকির এমনই এক কবিরাজ আকবর শেখ জোর গলায় দাবি করলেন, ‘‘গাছের শিকড়ের অনেক শক্তি। শিকড় দিয়ে হাড় জোড়া লাগাই। সঙ্গে দৈবপ্রদত্ত শক্তি তো রয়েছে। সে শক্তি থাকলে ডাক্তারি পড়ে শেখার দরকার নেই।’’ খাজুরির এমন এক বৈদ্য জাকির শেখের কথাতেও, ‘‘গাছগাছড়া তো আছেই আর সঙ্গে রয়েছে আমার হাতের জাদু। এক দিনের মধ্যে রোগী হাড় জুড়ে টগবগ করবে।’’

তবে কল্যাণী থানার পুলিশকর্মী সাহেব শেখের অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর। দিন সাতেক আগের দুষ্কৃতীদলকে ধাওয়া করতে গিয়ে মোটরবাইক থেকে পড়ে গিয়ে বাম পায়ের নীচের অংশে আঘাত লাগে তাঁর। হাড় ভাঙে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে এক বন্ধুর পরামর্শে যান খাজুরিতে হাড় জোড়া দিতে। তাঁর অভিযোগ, কবিরাজের ডেরায় পাঁচ জন মিলে চেপে ধরে ভাঙা জায়গায় কবিরাজি তেল-শিকড় বাটা-ভাত মিশিয়ে চাপ দিতে থাকেন। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে কোনওমতে পালিয়ে আসেন। রবিবার কল্যাণীর একটি নার্সিংহোমে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর পায়ের অবস্থা খুব খারাপ। বছর পঁচিশেক আগে ধুবুলিয়ার বাসিন্দা সহেল শেখের হাত ভেঙেছিল। তাঁরও অভিযোগ, কবিরাজের খপ্পরে পড়ে আজও তাঁর বাম হাত বাঁকা হয়ে রয়েছে।

স্বাস্থ্য দফতর কি এঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারে না? নদিয়া জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায়ের বক্তব্য, ‘‘কেউ অভিযোগ জানালে দেখব বিষয়টি।’’ ধরা যাক কেউ অভিযোগ জানালেন না, তা হলে কি রাস্তাঘাটে লাগানো পোস্টার, ব্যানার, ফ্লেক্স দেখে স্বাস্থ্য দফতর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে না?

এ বার স্বাস্থ্য আধিকারিকে জবাব, ‘‘এইরকম আজগুবি বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বুঝি! সে সব নজরে পড়েনি। তবে এ বার খোঁজ নেব।’’ পুলিশের তরফ থেকেও জানানো হয়েছে, কেউ অভিযোগ জানালে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন