মুম্বই-কাণ্ডে শোকস্তব্ধ গ্রাম

ভাঙা বাড়িতে বড়ঞার চার

দশ ভাইয়ের একটি মাত্র বোন। বড় আদরের। কিন্তু তাঁর সেই গর্বের জায়গাটাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন রবিনা বিবি। গত শনিবার যে মুম্বইয়ের কামাটিপুরার ১৪ নম্বর গলিতে একটি পুরনো বাড়ি ভেঙে পড়ে তাঁর তিন ভাই সারফুল মোল্লা(২৮), সামিরুল মোল্লা(২৪), জাবারুল মোল্লা(১৭) মারা গিয়েছেন। বাঁচেনি বছর পনেরোর ভাইপো মিস্টার মোল্লাও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কান্দি শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ০১:৫০
Share:

মোল্লা বাড়িতে ভিড় পড়শিদের। কৌশিক সাহার তোলা ছবি।

দশ ভাইয়ের একটি মাত্র বোন। বড় আদরের। কিন্তু তাঁর সেই গর্বের জায়গাটাই ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন রবিনা বিবি। গত শনিবার যে মুম্বইয়ের কামাটিপুরার ১৪ নম্বর গলিতে একটি পুরনো বাড়ি ভেঙে পড়ে তাঁর তিন ভাই সারফুল মোল্লা(২৮), সামিরুল মোল্লা(২৪), জাবারুল মোল্লা(১৭) মারা গিয়েছেন। বাঁচেনি বছর পনেরোর ভাইপো মিস্টার মোল্লাও।

Advertisement

বাড়িটি মেরামতির কাজ করছিলেন তাঁরা। দুপুরে হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সেটি। তাতেই মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার বড়ঞা থানার বেলডাঙা গ্রামের মোল্লা পরিবারের চার জনের মৃত্যু হয়েছে। সারফুলদের আর এক ভাই কিয়ারুল মোল্লা গুরুতর জখম। তিনি মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

এই ঘটনায় গোটা গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই মোল্লা পরিবারের উঠোনে পড়শিদের ভিড়।

Advertisement

সরিফুলদের বাবা জিফাই মোল্লার কোনও জমিজমা নেই। গরিবের সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। দিনমজুরি করেই কোনও মতে সংসার টেনেছেন। তার উপর দশ ছেলে, এক মেয়ে। এই পরিস্থিতিতে ছেলেরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রুজির টানে ভিন্‌ রাজ্যে পাড়ি দিতে শুরু করেন। রোজগারের এই রাস্তা প্রথম দেখান বাড়ির মেজ ছেলে টনিরুল মোল্লা। তার পরে ধীরে ধীরে সব ভাইকেই নিয়ে যান মুম্বইয়ে। লাগিয়ে দেন রাজমিস্ত্রী ও দিনমজুরের কাজে।

এ ভাবে বছর আটেক ভিন্‌ রাজ্যে কাজ করে সংসারে অনেক উন্নতিও হয়েছে। দশ ছেলের প্রত্যেকের নিজস্ব মাটির বাড়ি। এরই মধ্যে সামিরুল আবার পাকাবাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। শুধু ঘরের ছাদ দেওয়াই বাকি ছিল। এ দিন সামিরুলের স্ত্রী রেহেনা বিবি বলেন, “ঘটনার দিন দুপুরেও আমাকে ফোন করেছিল ও। ছোট ছেলেটা কান্নাকাটি করছিল বলে বলেছিলাম কিছু ক্ষণ পরে ফোন করো। ও জানতে চেয়েছিল, আমাদের খাওয়া হয়ে গিয়েছে কি না।’’ কাঁদতে কাঁদতে বলে চলেন রেহেনা বিবি, ‘‘বলেছিল এই বাড়ির কাজটা শেষ হয়ে গেলে যে টাকা পাবে, সেটা দিয়েই ঘরের ঢালাই দেওয়া হয়ে যাবে।” তার পরে ওই রাতেই খবর এল। রেহেনা বিবির কথায়, “আমাদের তিন জা-এর প্রত্যেকের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। কী ভাবে ওদের বড় করব, ভাবতে পারছি না। সব শেষ হয়ে গেল।”

দাদাদের মৃত্যুর খবর আসার পর থেকে এক ফোঁটা জলও মুখে তোলেননি বোন রবিনা। এ গ্রামেই শ্বশুরবাড়ি। তাই খবর পৌঁছতে সময় লাগেনি। রাস্তার ধারে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে বসে রবিনা বিবি বলেন, “আমার দশটা ভাই। সবাই আমাকে খুব ভালবাসে। সব সময় চোখের সামনে দেখতে পাবে বলে গ্রামেই আমার বিয়ে দিয়েছিল। মুম্বই থেকে যে যখন আসত, আমার জন্য কিছু-না-কিছু না নিয়ে বাড়ি ফিরত না। ছোট ভাইপোটাও চলে গেল।”

বড়ঞা ব্লকের কল্যাণপুর ১ নম্বর গ্রামপঞ্চায়েতের বেলডাঙা গ্রামের সদস্য তৃণমূলের আব্দুল হাই বলেন, “অন্য গ্রামে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু আমাদের গ্রামেও যে ঘটবে, সেটা ভাবতে পারিনি। পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকে যাতে ওই পরিবারকে সব ধরনের সাহায্য করা যায়, সেটা দেখব।”

কান্দির এসডিও বিজিনকৃষ্ণ জানিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৃতদেহগুলো মুম্বই থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ওই পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে যা যা সাহায্য করা যায়, অবশ্যই করা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন