মজুত সরষে, তেলে আগুন  

বিগত মরশুমে দেশে সরষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার থেকেও প্রায় চার লক্ষ মেট্রিক টন বেশি হয়েছে।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২১ ০৬:০৮
Share:

প্রতীকী ছবি।

শুঁকে বা চেখে দেখার দরকার নেই! দাম শুনলেই সরষের তেলের ঝাঁঝে সত্যিই চোখে জল এসে যাচ্ছে আম বাঙালির। শনিবার নদিয়া জুড়ে স্থানীয় ঘানিতে পেষা সরষের তেল কেজি প্রতি ১৮০ টাকা বা তারও বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডেড কোম্পানির তেলের দাম ছিল প্রতি লিটার ১৬০-১৭০ টাকা। অথচ বছরখানেক আগেও খোলা বাজারে ক্রেতারা সব ধরনের ভোজ্য তেল কিনেছেন প্রায় অর্ধেক দামে। গত বছর লকডাউনের আগে লোকাল সরষে তেলের দাম ছিল ১০০-১১০ টাকা প্রতি কেজি। অন্যদিকে ব্র্যান্ডেড কোম্পানির ভোজ্য তেলের দাম ছিল ৯৫-১০০ টাকা লিটার।

Advertisement

করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে জারি হওয়া লকডাউনের জের এখনও সামলাতে পারেননি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত থেকে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। কয়েক মাস ভোটের ডামাডোলের মধ্যে প্রবল আকারে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে ‘ত্রাহি মধুসূদন’ রব দেশ জুড়ে। এরই মধ্যে নীরবে বেড়ে চলেছে যাবতীয় তেলের দাম – ভোজ্য থেকে জ্বালানি সবই আকাশছোঁয়া। দু’ফোঁটা সরষের তেল ফেলে আলুভাতে ভাত কিংবা পেঁয়াজ-লঙ্কা দিয়ে পান্তা— কোনওটাই আর হাতের নাগালের মধ্যে রইল না।

অথচ বছরখানেক আগেও তেলের এমন লাগামছাড়া দাম ছিল না। কী এমন ঘটল এর মধ্যে যেখানে দেশ জুড়ে ভোজ্যতেলের এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করল? জেলার তেলের কারবারিদের দাবি, বিগত মরশুমে দেশে সরষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার থেকেও প্রায় চার লক্ষ মেট্রিক টন বেশি হয়েছে। তা হলে? পুরুষানুক্রমে ঘানির সরষের তেলের উৎপাদক মানিক গড়াইয়ের মতে, “গত এক বছরের মধ্যে সরষে এবং তা থেকে তেল উৎপাদন ও বিপণনের বিষয়টি আমূল বদলে গিয়েহে। কেন্দ্র সরকারের নতুন আইন করে পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়াই এই মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।” তাঁর ব্যাখ্যা, মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর হাতেই বেশির ভাগ সরষের মজুত ভাণ্ডার থেকে যাওয়ায় তাঁরাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে হু-হু করে চড়ছে দাম।

Advertisement

মানিক গড়াই বলেন, “আমাদের এখানে পৌষের শেষ থেকে মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র পর্যন্ত সরষে উৎপন্ন হওয়ার সময়। সেই সময় আমরা চাষিদের কাছ থেকে সরষে কিনতে পারি। বৈশাখ থেকে বাকি বছর আমাদের সরষের জন্য ভরসা করতে হয় মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যের উপর। কমিশনড এজেন্টদের মাধ্যমে আমরা ওদের কাছ থেকে সরষে কিনি। তাঁরা যে দর ঠিক করে দেন সেই দরের নিরিখেই বাজারে তেলের দাম ঠিক হয়।”

ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গত বছর লকডাউনের ঠিক আগে যে সরষে তাঁরা জিএসটি দিয়ে ৪৫.৫০ টাকায় কিনেছেন, এখন তার দাম ৭৫ টাকা। তাঁদের আশঙ্কা, সরষের তেলের দাম বেড়ে ২০০ টাকা কেজি ছুঁতে পারে। চলতি বছরে স্থানীয় ভাবে সরষে ওঠার মরশুমে সরষের তেলের দাম ছিল ১৫০ টাকা কেজি। কয়েক মাসের মধ্যে তা বেড়ে ১৮০ থেকে ১৮৫ টাকায় বিকোচ্ছে।

ভোজ্য তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পিছনে দেশের অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের যে সংশোধনীর দিকে সকলে আঙুল তুলছেন সেটি ২০২০ সালে জুন মাসে (০৫/০৬/২০২০) অর্ডিন্যান্স হিসাবে জারি করা হয়। তিন মাসের মাথায় সেপ্টেম্বরে (২৬/০৯/২০২০) তা সংসদের অনুমোদন পেয়ে আইনে পরিণত হয়। ‘দি এসেনশিয়াল কমোডিটিস অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০২০’ অনুসারে আইনের বলে পণ্যের মজুত এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার সাধারণ ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না। একমাত্র দেশে মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, যুদ্ধ ইত্যাদি জরুরিকালীন পরিস্থিতিতেই সরকার অত্যাবশ্যক পণ্যের মজুত এবং মূল্য নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করবে। এই আইনের ফলে ভোজ্যতেলের মজুত, উৎপাদন এবং বিপণন কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ীর হাতে। তারই পরিণতি ভোজ্যতেলের দামে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। যদিও তেল বাদে চিনি, আটা, ডাল ইত্যাদির দামে এই সময়কালে বিশেষ হেরফের হয়নি।

নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ়ের যুগ্ম সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহাও বলেন, “ভোজ্য তেলের এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন। যেখানে পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। তার পাশাপাশি, মূল্য নির্ধারণে সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। ফলে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলে দেশ জোড়া বাজারে নির্বিচার আধিপত্য কায়েম করছে। সেই সঙ্গে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ভিন্ রাজ্য থেকে ভোজ্য তেল আমদানির খরচ বাড়ছে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন