ব্যাঙ্কে লাইন ধরছে খুদেরা। — নিজস্ব চিত্র
সাতসকালে ব্যাঙ্কে এসে মাথায় হাত ডোমকলের এক স্কুল শিক্ষককের।
ব্যাঙ্কের সামনে থেকে লাইনটা এঁকেবেঁকে এতটা দূরে চলে গিয়েছে যে, লেজটা দেখাই যাচ্ছে না। হতাশ হয়ে স্কুটি ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরবেন, ঠিক সেই সময়ে এগিয়ে এলেন বছর বাইশের এক যুবক। স্কুটির লুকিং গ্লাসের কাচে চুলটা ঠিক করে ছুড়ে দিলেন মোক্ষম অফার, ‘‘সামনে একশো, মাঝে পঞ্চাশ আর পিছনের দিকে হলে ত্রিশ।’’
শিক্ষকের চোখমুখ দেখে যুবক বলে চলেছেন, ‘‘কী, বুঝলেন না তো? লাইনের কথা বলছি, মাস্টারমশাই। ছেলেপুলে লাইনেই আছে।’’ ওই শিক্ষক আর কথা বাড়াননি। টাকাটা বের করে দিতেই হুকুম গেল, ‘‘ওরে, মাস্টারকে একটা জায়গা দিয়ে দে।’’ জায়গা ছেড়ে বছর বারোর একটি ছেলে তার প্রাপ্য বুঝে নিয়ে একছুটে বাড়ি। এ বার স্কুলে যেতে হবে যে।
ছবিটা একই রকম কল্যাণীতেও। তবে সেখানে লাইনের দাম অবশ্য একটু বেশি। ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা। দর-দাম করে কখনও কখনও কিঞ্চিৎ কমছে। আর লাইনের সে কাজ সামলাচ্ছেন যুবকেরাই। কল্যাণীর একটি ব্যাঙ্কের সামনে বেশ কয়েকজন যুবক কাকভোর থেকেই ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিচ্ছেন। লম্বা লাইন দেখে কেউ ফিরে যাচ্ছেন দেখলেই তাঁরা বলছেন, ‘‘লাইনে জায়গা চাই? কিছু খরচা করুন।’’
সে প্রস্তাবে সাড়াও দিয়েছেন অনেকে। হরিণঘাটার এক বৃদ্ধ জানান, তাঁর কাছে ২০০ টাকা চাওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি ১০০ টাকাতে রফা করে লাইনের সামনের দিকে দাঁড়ানোর সুযোগ পান। ১৫০ টাকা দিয়ে কল্যাণী সেন্ট্রাল পার্কের একটি ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে সামনের সারিতে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন স্থানীয় এক স্কুল শিক্ষকও। ৮ নভেম্বর রাত থেকে এক হাজার ও পাঁচশো টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ঠিক তার পরের দিন থেকেই ভিড় ভেঙে পড়েছে ব্যাঙ্ক ও এটিএমগুলির সামনে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এখন প্রধান কাজ ব্যাঙ্ক কিংবা এটিএমের লাইনে দাঁড়ানো। আর সেই লাইনকে ব্যবহার করেই রোজগারের রাস্তায় নেমে পড়েছেন অনেকেই।
সেই তালিকায় যেমন রয়েছেন এলাকার কিছু যুবক, তেমনি রয়েছে স্কুল পড়ুয়ারাও। তারা সকাল সকাল উঠে সটান দাঁড়িয়ে পড়ছে লাইনের সামনের সারিতে। তারপর ‘খদ্দের’ পেলেই জায়গা বেচে বাড়ি। গত ক’দিন ধরেই সীমান্তের ডোমকল, রানিনগরের মতো বেশ কিছু এলাকায় স্কুল পড়ুয়ারাই এখন ‘লাইনম্যান’। খুচরোর আকালে তারাও কিছু টাকা আয় করতে পারছে। আবার তাদের একত্রিত করে ‘খদ্দের’ পাইয়ে দিয়ে ‘কমিশন’ও আদায় করছে এলাকার জনাকয়েক যুবক।
আপনি কি জানেন, কাজটা বেআইনি?
ডোমকলের এক অভিভাবক নির্বিকার গলায় বলছেন, ‘‘আইন-টাইন বুঝি না দাদা। নোট বাতিলের পরে তেমন কাজ পাচ্ছি না। ছেলেমেয়েগুলো দু’পয়সা রোজগার করে আনছে। ওই টাকাতেই বাড়িতে দু’বেলা উনুন চড়ছে।’’ ডোমকলের এক মুটিয়ার কথায়, ‘‘আমি একটি চালের গুদামে মাস মাইনের কাজ করি। গত মাসে যে টাকা পেয়েছি তা সবই ৫০০ টাকার নোট। ছেলেটা স্কুল যাওয়ার আগে লাইনে দাড়িয়ে যে টাকা নিয়ে আসছে তাতে তেল, ডাল, নুন হয়ে যাচ্ছে। আর চালটা মালিক দিচ্ছে।’’
অতএব লাইন চলছেই। ভোর ৩ টে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ছে ডোমকলের জনাকয়েক পড়ুয়া। পরে আসছেন ‘মিডলম্যান’। ব্যাঙ্কে আসা লোকজনের চোখমুখ দেখেই তাঁরা আন্দাজ করছেন, কার কত তাড়া আছে। সেটা বুঝে তাঁরাই দর-দামের কাজটা সারছেন। ডোমকলের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলছেন, ‘‘আমিও ওই পড়ুয়াদের লাইনে দাঁড়াতে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। ওদের হাতে কোনও কাগজপত্র না দেখে একবার জানতে চেয়েছিলাম, ওরা লাইনে দাঁড়িয়ে কেন। উত্তর এসেছিল, বাবা আসবে। পরে বুঝতে পারি, আসলে ওরা লাইন বিক্রি করছে। আমি নিজেও তো পঞ্চাশ টাকা দিয়ে জায়গা কিনেছি।’’
ডোমকলের পঞ্চম শেণির এক পড়ুয়ার কথায়, ‘‘বাবার তো এই সময় কোনও কাজ নেই। এইটুকু না করলে খেতে পাব না। তাছাড়া এটা করেই তো আমি স্কুলে যাচ্ছি।’’ আর লুকিং গ্লাসে চুল ঠিক করে নেওয়া সেই ‘মিডলম্যান’ বলছেন, ‘‘আমরা বেকার ছেলে। এই বাজারে এটা করে দু’পয়সা আয় করছি। মানুষকে তো আর ঠকাচ্ছি না। পরিশ্রম করে তাদের জন্য জায়গা ধরে রেখে বিনিময়ে কিছু টাকা নিচ্ছি।’’ তবে জেলা পুলিশের এক আধিকারিক বলছেন, ‘‘কাজটা একেবারেই বেআইনি। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ অভিযোগ জানালেই আমরা ব্যবস্থা নেব।’’