বাঁ দিকে, ৮১ কিমিতে প্রথম বাংলাদেশের আশিকুর রহমান। মাঝে, ১৯ কিমিতে প্রথম দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুজন নস্কর। ডান দিকে, মেয়েদের মধ্যে প্রথম হন নোনা চন্দনপুকুরের মধুলেখা হাজরা।—নিজস্ব চিত্র।
ভাগীরথীর বুকে ৭২তম সাঁতার প্রতিযোগিতায় জয়ের পতাকা উড়ল বাংলাদেশের। সৌজন্যে বাংলাদেশ সেনা ও নৌবাহিনীর প্রতিযোগীরা।
বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ ৮১ কিলোমিটার সাঁতার প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মহম্মদ আশিকুর রহমান ও ফয়জল আহমেদ। জঙ্গিপুরের আহিরণ ঘাট থেকে বহরমপুর গোরাবাজার ঘাট পর্যন্ত ৮১ কিলোমিটার অতিক্রম করতে আশিকুর সময় নিয়েছেন ১১ ঘণ্টা ৪ মিনিট ২৭ সেকেন্ড। ফয়জলের সময় লেগেছে ১১ ঘন্টা ২৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। তৃতীয় হয়ে বহরমপুরের মান রাখেন বহরমপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের বিশ্বনাথ অধিকারী।
যদিও বহরমপুরের মানুষ গত তিন বছরের মতো বহরমপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের রাকেশ বিশ্বাস ও তাঁর ভাই চিরঞ্জিৎ বিশ্বাসের উপরে ভরসা করেছিলেন। কারণ, ৮১ কিমি প্রতিযোগিতায় ২০১২ সাল থেকে এক টানা তিন বার প্রথম হন রাকেশ এবং গত দু’বছর দ্বিতীয় হন চিরঞ্জিৎ। ফলে ওই দুই ভাইকে ঘিরে বহরমপুরের মানুষ ভাবছিলেন— দাদা একটানা চার বার জয়ী হওয়ার নজির সৃষ্টি করবে, নাকি দাদাকে হারিয়ে ভাই এ বার প্রথম স্থান পাবে! কিন্তু এ দিন মাঝ পথেই হাল ছাড়েন দুই ভাই।
তবে জিয়াগঞ্জ সদর ঘাট থেকে গোরাবাজার ঘাট পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার প্রতিযোগিতায় ৮১ কিলোমিটারের মতো সাফল্য দেখাতে পারেননি বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা। ওই বিভাগে দক্ষিণ ২৪ পরগণার তালদি সুইমিং ক্লাবের সুজন নস্কর ২ ঘন্টা ১২ মিনিট ২ সেকেন্ডে প্রথম হন। ১৯ কিমি পুরুষ বিভাগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পলাশ চৌধুরী দ্বিতীয় হন। তাঁর সময় লাগে ২ ঘন্টা ১৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ড। তৃতীয় হন বলাগড় থানা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সুকুঞ্জন হাজরা। তাঁর সময় লেগেছে ২ ঘন্টা ১৮ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড। অন্যদিকে, ১৯ কিমি মহিলা বিভাগে প্রথম হন নোনা চন্দনপুকুর ক্লাবের মধুলেখা হাজরা, দ্বিতীয় কলকাতা স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের শ্রেয়সী চক্রবর্তী ও তৃতীয় হন বহরমপুর উমাসুন্দরী অ্যাথলেটিক ক্লাবের সৃষ্টি উপাধ্যায়। তাঁরা সময় নিয়েছেন যথাক্রমে ২ ঘন্টা ১৬ মিনিট ৩০ সেকেন্ড, ২ ঘন্টা ১৮ মিনিট ১৭ সেকেন্ড ও ২ ঘন্টা ২০ মিনিট ৫০ সেকেন্ড।
এলাকার যুবকদের সাঁতারে উৎসাহিত করতে বহরমপুরের মহারানি স্বর্ণময়ী সমিতি ১৯২৮ সালে ভরা বর্ষায় ভাগীরথীর বুকে জলকলঘাট থেকে কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘাট পর্যন্ত দু’মাইল সাতাঁর প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। খাগড়ার তারাপদ দাস ও শ্যামাপদ দাস এবং গোরাবাজারের বিনয়ভূষণ পাল যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন। বহরমপুরে সাঁতার প্রতিযোগিতার সেই শুরু। সাঁতার প্রতিযোগিতার দিন শহরের বিভিন্ন ঘাটে থাকত দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়। সেই রেওয়াজ এখনও রয়ে গিয়েছে। পরের বছর থেকে ওই প্রতিযোগিতা বেড়ে হয় তিন মাইল। কিন্তু ১৯৩২ সাল থেকে আচমকা ওই প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। পরে ১৯৩৮ সালে বহরমপুরের ব্রহ্মপদ দত্তের ‘দত্ত ভবনে’ কয়েক জন যুবক একজোট হয়ে গড়ে তোলেন বহরমপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন।
ওই নতুন কমিটি ফের প্রতিযোগিতার সূচনা করে। কুঞ্জঘাটার জলকল থেকে কলেজ ঘাট পর্যন্ত ওই সাঁতার প্রতিযোগিতা শুরু হলেও ১৯৪১ সালে লালবাগ কোর্ট ঘাট থেকে কৃষ্ণনাথ কলেজ ঘাট পর্যন্ত সাত মাইলের প্রতিযোগিতা আয়োজন হয়। ১৯৪৪ সালে জিয়াগঞ্জ সদর ঘাট থেকে বহরমপুর কলেজ ঘাট পর্যন্ত ১৯ কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতার সূচনা হয়। তারও পরে ১৯৬১ সাল থেকে জঙ্গিপুর সদর ঘাট থেকে গোরাবাজার ঘাট পর্যন্ত ৭৪ কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতা আয়োজন করে বিশ্বের দীর্ঘতম সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম ওঠে।
১৯৬২ সালে সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন বেঙ্গল অ্যামেচার সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার পরে সাঁতার প্রতিযোগিতাও বেড়ে ৮১ কিমিতে পরিণত হয়। এ বছর ৮১ কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতায় যোগ দেন মোট ১২ জন প্রতিযোগী। অন্য দিকে ১৯ কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতায় পুরুষ বিভাগে ৪৭ জন এবং মহিলা বিভাগে ১৪ জন যোগ দিয়েছিলেন।
আয়োজক সংস্থার সম্পাদক আশিসকুমার ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যের প্রতিযোগীর পাশাপাশি মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পণ্ডিচেরি, জম্মু-কাশ্মীর ছাড়াও বাংলাদেশের ৬ জন প্রতিযোগী যোগ দেন। সব মিলিয়ে প্রতিযোগীর সংখ্যা ছিল ৭৪ জন।’’ ১৯ কিমি সাঁতার প্রতিযোগিতা আকর্ষণীয় করে তুলতে আজিমগঞ্জের রানি ভবানি মন্দিরের কাছ থেকে জিয়াগঞ্জ সদর ঘাট পর্যন্ত ৬ কিমি নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। এক দাঁড়ের ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে যে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হয়, তাতে ১০০ জন প্রতিযোগী যোগ দেন। সাঁতার প্রতিযোগিতা দেখতে সদরঘাটে উৎসাহী দর্শকদের ১০০টি ছাতাও দেন জিয়াগঞ্জের পুরপ্রধান শঙ্কর মণ্ডল।