হাসপাতাল? বাঁধা রেট পাঁচ টাকা

তাদের তিন চাকার টলমল দৌড়ের মতোই ভবিষ্যৎটাও টালমাটাল। এখনও মেলেনি সরকারি ছাড়পত্র। যে কোনও দিন বন্ধ করে দেওয়া হবে— ঝুলে আছে এমনও খাঁড়া। অটো আর রিকশা, স্ট্যান্ডের ও পার থেকে তাদের গালমন্দও উড়ে আসছে অহরহ।

Advertisement

সুজাউদ্দিন

ডোমকল শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৬ ০১:৫৯
Share:

টোটোয় হাসপাতালে। ডোমকলে সাফিউল্লা ইসলামের তোলা ছবি।

তাদের তিন চাকার টলমল দৌড়ের মতোই ভবিষ্যৎটাও টালমাটাল।

Advertisement

এখনও মেলেনি সরকারি ছাড়পত্র। যে কোনও দিন বন্ধ করে দেওয়া হবে— ঝুলে আছে এমনও খাঁড়া। অটো আর রিকশা, স্ট্যান্ডের ও পার থেকে তাদের গালমন্দও উড়ে আসছে অহরহ।

তবুও গাঁ-গঞ্জ থেকে শহরতলিতে রাতবিরেতে তারাই এখন মুশকিল আসান, টোটো।

Advertisement

তাই বলে চলার পথ কিন্তু মসৃণ নয়। টোটো-চালককে নিঃশব্দে সয়ে যেতে হয় রিকশার হুমকি, অটোর শাসানি। টিঁকে থাকার দৌড়ে কখনও কখনও জুটে যায় মারধরও।

অথচ ডোমকলের সেই টোটো চালকদের অবস্থাও যে খুব ঈর্ষা করার মতো, তা কিন্তু নয়। তাঁদেরও নুন আনতে ভাত ফুরোয়। ধার কিংবা শেষ জমিটুকু বন্ধক নিয়ে কেনা টোটোর টাকা শোধ করতে তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। সংসারে দু’পয়সা বাড়তি আয়ের জন্য বাবার টোটো চালাতে দেখা গিয়েছে খুদেদেরও।

অথচ এই অবস্থায় দাঁড়িয়েও তাঁরা প্রমাণ করে দিলেন— ইচ্ছে থাকলেই মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। গরিব-গুর্বো সেই টোটো চালকদের মানবিক মুখ দেখে এখন ডোমকলও বলতে শুরু করেছে, ‘‘ওরা আমাদের গর্ব।’’ কিন্তু কী করেছে ডোমকলের টোটো-কোম্পানি?

সীমান্ত ঘেঁষা ডোমকলে এখন শতাধিক টোটো চলছে। সব থেকে কম ভাড়া ১০ টাকা। সে ভাবেই চলছিল। মাসকয়েক আগে টোটো চালকেরা নিজেদের সংগঠন তৈরি করেন। সেই সময়েই কথাটা পাড়েন বেশ কয়েকজন চালক।

তাঁরা সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের জানান, প্রতি মূহূর্তে রাস্তাঘাটে সবথেকে হেনস্থা হতে হয় অসুস্থ গরিব মানুষকে। রিকশা কিংবা অন্য গাড়ির চালকেরা হয় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়া দাবি করেন অথবা অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করেন। এটা যাতে না হয় সেই জন্য তাঁরা অসুস্থ লোকজনকে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে কম ভাড়া ৫ টাকা করার প্রস্তাব দেন। সংগঠনও সেই প্রস্তাবে সায় দেয়।

তারপর থেকে পাঁচ টাকা ভাড়া তো মিলছেই। তার থেকেও বেশি জুটছে দোয়া আর আশীর্বাদ। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন? ভিড় রাস্তায় টোটো চালাতে চালাতে সেলিম শেখ বলছেন, ‘‘গরিবের কষ্ট গরিবেই বোঝে। পথেঘাটে অসহায়, অসুস্থ লোকজনকে দেখে খারাপ লাগত। তাই এই সিদ্ধান্ত। হয়তো এটা বিরাট কিছু নয়। কিন্তু তবুও তো কিছু করতে পারলাম। এটা ভেবেই ভাল লাগছে।’’

ধার-দেনা করে টোটো কিনেছেন ডোমকল পাঠানপাড়ার ফুলবাস শেখ। ফুলবাসের কথায়, ‘‘চোখের সামনে দেখেছি, ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফেরার সময় পকেট ফাঁকা। রিকশা কিংবা টোটোতে উঠতে না পেরে কষ্ট করে পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন রোগী নিজে। এই রোদে-গরমে সেই কষ্ট চোখে দেখা যায় না। তাই রোগীদের জন্য পাঁচ টাকা। আর কোনও ক্ষেত্রে যদি দেখি সেটুকুও দেওয়ার মতোও কারও সামর্থ্য নেই, তাহলেও পৌঁছে দেব।’’ ডোমকল টোটো ইউনিয়নের সম্পাদক সুরজ সামিন বলেন, ‘‘অভাব-অনটন আমাদেরও আছে। তবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আনন্দও কম নয়।’’

ডোমকল মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক বরুণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ডোমকলের টোটো চালকদের এই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাচ্ছি।’’ স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্বাস আলির কথায়, ‘‘সারাদিনে ওঁরা খুব বেশি হলে দু’শো টাকা আয় করেন। ওই পাঁচ টাকা না কমালে ওঁরা অন্তত আরও পঞ্চাশ টাকা বেশি আয় করতেন। ওঁরা দেখিয়ে দিলেন যে, কষ্টের মধ্যে থেকেও অন্যের কষ্ট লাঘব করা যায়।’’

ডোমকলের ৮০ শতাংশ মানুষকে হাসপাতালে যেতে হলে বাস থেকে নামতে হয় বাসস্ট্যান্ড কিংবা পুরনো বিডিও মোড়ে। সেখান থেকে প্রায় দেড় কিমি দূরে ডোমকল মহকুমা হাসপাতাল। কিন্তু টোটোর সৌজন্যে এখন স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। সটান যাওয়া যাচ্ছে হাসপাতালের দোরে। ডোমকলের বাগডাঙার তাহাসেন শেখ বলছেন, ‘‘হাসপাতালে পৌঁছে টোটো চালকের হাতে দশ টাকা গুঁজে দিয়ে হাঁটা দিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি পিছন থেকে ডাকছেন চালক। কাছে যেতে পাঁচ টাকা ফিরিয়ে জানান রোগীদের জন্য নাকি এটাই ভাড়া।’’

হিংসা, কোন্দল ডোমকল অনেক দেখেছে। কিন্তু এমন ‘অচেনা’ ডোমকল? নাহ্, মনে করতে পারছেন না কেউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন