মুরগির ছানা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠল নদিয়া জেলা প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের বিরুদ্ধে।
গেল অর্থবর্ষে নদিয়া জেলার কয়েক হাজার উপভোক্তার মধ্যে ৩ লক্ষ ২৪ হাজার মুরগির ছানা বিতরণের কথা ছিল। কীভাবে ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে সে বিষয়ে দফতরের অধিকর্তা জেলার আধিকারিকদের লিখিত নির্দেশ দেন। সেখানে উল্লেখ ছিল, ‘‘সরকারি খামার থেকে মুরগি কিনে তা উপভোক্তাদের মধ্যে বিলি করতে হবে।’’ অভিযোগ, নদিয়া জেলার প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতর ওই নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছে। তারা বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে মুরগি কিনেছে। মুরগি বিতরণ কমিটির চেয়ারম্যান তথা তৃণমূল পরিচালিত নদিয়া জেলা পরিষদের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ চঞ্চল দেবনাথ। সরকারি খামারগুলির ইনচার্জ ও ব্লক স্তরের প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন আধিকারিকদের অভিযোগ, চঞ্চলবাবুর চাপেই বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে মুরগি কেনা হয়েছে।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীদের মহিলাদের, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী মহিলাদের স্বশক্তিকরণ প্রকল্প ও ‘ব্যাকয়ার্ড (চিরাচরিত) পোল্ট্রি উন্নয়ন প্রকল্প’-এর মাধ্যমে মহিলার মধ্যে মুরগির ছানা বিতরণ করার কথা। পঞ্চায়েত সমিতির প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের কর্মাধ্যক্ষরা তিনটি প্রকল্প মিলিয়ে ২১ হাজার ৯০০ জন উপোভোক্তাকে বাছেন। রাজ্য সরকারের অর্থানুকুল্যে চলা প্রথম দুই প্রকল্পে ইতিমধ্যে ১ লাখ ৮৯ হাজার মুরগি বিতরণ করা হয়েছে। তৃতীয় প্রকল্পের মুরগি বিতরণ সেভাবে শুরু হয়নি।
গেল বছরের ১৭ জুন প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের অধিকর্তা জেলার উপ অধিকর্তাকে লিখিত নির্দেশে জানান, ‘‘সরকারি খামার থেকেই মুরগির বাচ্চা কিনে তা উপভোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। মুরগি বিলি খাতে দফতরের কাছে অর্থ না থাকলে খামার থেকে ধারে বাচ্চা নিতে হবে। খামারগুলিতে প্রয়োজনীয় বাচ্চা না থাকলে সেক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিয়ে অন্য জায়গা থেকে বাচ্চা কেনা যেতে পারে।’’ নদিয়া জেলায় তিনটি সরকারি মুরগি খামার রয়েছে। কৃষ্ণনগর, রানাঘাট ও হরিণঘাটা খামারের কর্তৃপক্ষদের অভিযোগ, মুরগি বিতরণ কমিটি সেই নির্দেশকে বু়ড়ো আঙুল দেখিয়েছে। তাঁদের দাবি, খামার থেকে মুরগি কেনার ব্যাপারে সেভাবে উৎসাহই দেখায়নি কমিটি। উল্টে মুরগি কেনা হয়েছে ভিন জেলার বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে। জেলার প্রাণী সম্পদ দফতরের উপ অধিকর্তা মিন্টু চৌধুরী নিজেই জানাচ্ছেন, ‘‘বিলি হওয়া মুরগি ছানার ৪৭ শতাংশ কেনা হয়েছে সরকারি খামার থেকে।’’ বাকিটা কেনা হয়েছে বাইরে থেকে।’’ নির্দেশ ভেঙে কেনা এমনটা করা হল? মিন্টুবাবুর সাফাই, ‘‘মুরগি বিলির টাকা এসেছিল চলতি বছরের প্রথম দিকে। আবার এ দিকে অর্থবর্ষও শেষ হতে চলেছিল। তাই দ্রুত মুরগি বিলি শেষ করতে হয়েছিল। কম সময়ে ওত বচ্চা খামারগুলি জোগান দিতে পারেনি।’’
২০১৪ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ব্লক স্তরে উপভোক্তাদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়। পরে তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় জেলায়। নিয়ম অনুযায়ী, সারা বছরই মুরগি বিলি করার কথা। অধিকর্তার নির্দেশেও সারা বছর ধরেই কার্যসূচী রুপায়নের কথা বলা হয়। কিন্তু তা মানা হয়নি বলে অভিযোগ। জেলার এক সরকারি খামারের ইনচার্জ বলেন, ‘‘গেল বছরের মাঝের দিকে মুরগি বিলি খাতে টাকা এসেছিল। কিন্তু তখন আমাদের কাছ থেকে মুরগি কেনা হয়নি। ইচ্ছা করেই তাড়াহুড়ো করে মুরগি কেনা হয়েছে। যাতে আমরা পুরো জোগান দিতে না পারি।’’ জেলার প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘চার সপ্তাহ বয়সের মুরগির ছানা বিলির কথা। যার দাম ৩৬ টাকা। সরকারি খামার থেকে কিনলে আর্থিক অনিয়মের কোনও সুযোগই থাকে না।’’ বিভিন্ন ব্লকের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, চঞ্চলবাবুর নেতৃত্বে কমিটি তাঁদের বাধ্য করেছে বাইরে থেকে মুরগি কিনতে। সেক্ষেত্রে কম দামের মুরগি কিনে নির্ধারিত দামের বিল করা হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে অর্থের সাশ্রয়ের জন্য কম বয়সের মুরগি ছানাও কেনা হয়েছে। জেলার এক খামারের ইনচার্জ বলেন, ‘‘সরকারি টাকা নয়ছয় করার জন্যই কমিটি আমাদের কাছ থেকে মুরগি কিনল না।’’
মিন্টু চৌধুরীও স্বীকার করছেন, ‘‘সারা বছর ধরে মুরগি কিনলে খামারগুলি জোগানের সিংহভাগই দিতে পারত।’’ তাহলে তা করলেন না কেন? তিনি বলেন, ‘‘আমি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি উপ অধিকর্তা পদে যোগ দিয়েছি। তাই কেনা বছরভর মুরগি কেনা হল না, তা বলতে পারব না।’’ আর জেলা পরিষদের প্রাণী সম্পদ বিকাশ দফতরের কর্মাধ্যক্ষ তথা মুরগি বিতরণ কমিটির চেয়ারম্যান চঞ্চল দেবনাথ বলছেন, ‘‘উপভোক্তাদের নামের তালিকা ব্লক থেকে দেরিতে এসেছিল। টাকাও আসে অনেক পরে। তাড়াহুড়ো করে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে মুরগি কেনা হয়েছে।’’ এর ফলে যে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে? চঞ্চলবাবুর সাফাই, ‘‘কোনও অনিয়ম করিনি। বাইরে থেকে মুরগি কেনার জন্য ব্লক স্তরের আধিকারিকদের চাপও দিইনি।’’ যদিও মুরগি খামারের এক আধিকারিক জানাচ্ছেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে এখনও মুরগি বিলি চলছে। তাঁর খামারে ছানার জোগান থাকলেও সেখান থেকে মুরগি নিচ্ছেন না। চঞ্চলবাবু কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি।